ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সোহেল মাজহার

বই ॥ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ ॥ প্রাসঙ্গিক আলোচনা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১০ নভেম্বর ২০১৭

বই ॥ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ ॥ প্রাসঙ্গিক আলোচনা

এ্যাড. আনিসুর রহমান খান প্রথাগত অর্থে লেখক নন। তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা নিজস্ব দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভিন্ন সময় কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখাগুলো বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। সেইগুলো একত্রে সঙ্কলন করে “বিবিধ প্রসঙ্গ” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ বঙ্গবন্ধু স্মরণে। প্রবন্ধটিতে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের বিষয় সহজ সাবলীল যৌক্তিক ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। পাঠক সহজেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ধারাবাহিক ইতিহাস, আত্মত্যাগী ও মহত্ত্ব¡ অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও লেখক বিভিন্ন প্রবন্ধে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব, ঐতিহাসিক ছয়দফা, বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, ৭ মার্চের ভাষণ, জনমানস ও মুক্তিযুদ্ধে ভাষণের প্রভাব, ৭৫-এর অন্যায় হত্যাকা-ের ধারাবাহিকতায় ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন মেজর জিয়া নয়, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, গণপ্রতিনিধি হিসেবে ২৫ মার্চের পর একমাত্র বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত, যে সরকার ১৭ এপ্রিল শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে কার্যকর হয়, সেই সরকার তাদের দলিল ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের মহান স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আজ এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ। কাজেই আজ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলে তাকে অনাহুত বিতর্ক ছাড়া, আর কিছু বলা যাবে না। তারেক জিয়ার তত্ত্ব, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের আপোস প্রস্তাব, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, এ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমদের বক্তব্য যুক্তি দিয়ে আসার প্রমাণ করেছেন। এ বিষয়ে লেখক বলেন “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে সমকক্ষ করার বা সমপর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করবেন না। এতে জাতীয় নেতাদের খাটো করা হয়। জিয়াউর রহমানও খাটো হয়ে যায়। ইতিহাসে যার যতুটুকু অবদান তাই তাকে দেয়া উচিত” (পৃষ্ঠা-৫৭)। লেখক আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতীয় চার নেতা বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, নির্লোভ, নির্মোহ, কষ্টসহিষ্ণু নেতৃত্ব দ্বারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকে সফলভাবে পরিচালনা করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিশেষত রফিক উদ্দিন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হওয়ার ইতি বৃত্তান্ত। ফলে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলকে পাক বাহিনীর হাত হতে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়। পাশাপাশি স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণ নিয়ে। জাতীয় নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি স্বরণ করেছেন তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুল জব্বার আনছারী, প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মুনসুর আহমদ, আলোকময় নাহাসহ অনেককে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক অবৈধভাবে সামরিক শাসন জারির বৈধতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ও প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক তা আইনে রূপান্তর করার চক্রান্ত এবং পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সেই আইন সংশোধন করে বিচারকার্য সম্পন্ন করার আলোচনা করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করতে শেখ হাসিনার দুঃসাহসিক ভূমিকার কথা। পাশাপাশি আলোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনীতির ৪ কালো অধ্যায়। আলোকপাত করেছেন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা বিষয়ের ওপর। নিজের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, ভূমিকা পালন, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিবীদদের সাথে নিবিড় সম্পর্কের নানামাত্রার কথা অকপটে ব্যক্ত করেছেন। আবার তিনি কেন নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, সেই বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে ইউপি নির্বাচনে নৌকা বরাদ্দের সমম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। দলের অভ্যন্তরে পদ বাণিজ্য, রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা, তদবির বাণিজ্য, টেন্ডার, ঘুষ দুর্নীতির ভয়াবহতা তুলে ধরেন। দেশ ও দলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে খোলা পত্র লিখে তিনি নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। আবার. ড. কামাল হোসেনর রাজনৈতিক অভিলাষ সম্পর্কে পত্র লিখে নিজের মতামত তুলে ধরেন। সবক্ষেত্রেই আনিসুর রহমান খান অকপটে নিজের যুক্তি ও বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান স্মৃতিচারণ করেছেন ময়মনসিংহে আইন পেশার অতীত গৌরব ঐতিহ্যের। সামাজিক, নাগরিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক সংস্কার ও আন্দোলনে আইনজীবীদের গৌরোবজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে করেছেন তথ্যনির্ভর আলোচনা। অতীত প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে হতাশাবোধ করেন আইন পেশায় সর্বগ্রাসী দুনীর্তির কারণে। সৎ সাহস নিয়ে উচ্চারণ করেছেন, কোর্ট পুলিশ, পিয়ন, মোক্তার, সেরেস্তাদার, পেশকার, আইনজীবী ও বিচারক সবাই কীভাবে আকণ্ঠ দুনীর্তিতে নিমজ্জিত হয়। এ বিষয়ে তার একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- “আগে বিচার অঙ্গনে দুর্নীর্তি ছিল ,Open Secret, কিন্তু আজকাল Secret শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে”। (পৃষ্ঠা- ১১৬) আবার তিনি গ্রন্থে যৌক্তিক ভাষায় ধর্মনিপেক্ষতা প্রশ্নে সাংবিধানিক অসঙ্গতি উল্লেখ করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির স্বরূপ। আবার কীভাবে তা সামরিক শাসনামলে উপেক্ষিত হয়েছে সেই আলোচনার পাশাপশি বৃহত্তর জাতীয় জীবনে তার উপযোগিতা বিশ্লেষণ করেছেন। এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান যতটা লেখক তার থেকে বেশি সমাজ পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক। ১৯৬৩ সালে ময়মনসিংহ বারে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও পরবর্তীতে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন এবং দায়িত্ব পালন করেন মহাদের অভ্যর্থনা যুব শিবিরের চেয়ারম্যান হিসেবে। একজন শিক্ষাব্রতী মানুষ হিসেবে মোমেনশাহী ল. কলেজে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি একাধিকবার ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একজন নিষ্ঠাবান ও নাগরিক অধিকার আদায়ের সোচ্চার মানুষ হিসেবে ১৯৮৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন ও উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কাজেই “বিবিধ প্রসঙ্গ” মোড়কে তার আলোচনা দেশ সমাজের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্ত প্রাসাঙ্গিক। চিন্তক-দার্শনিক সমাজ বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক যতীন সরকার ভূমিকা লিখে গ্রন্থটির শ্রীবৃদ্ধি করেন। গ্রন্থটির সম্পাদক এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু। প্রকাশক বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী, ময়মনসিংহ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শামীম আশরাফ। শুভেচ্ছা মূল্য দু’শ’ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
×