কবি মতিন বৈরাগী কাব্যচর্চা শুরু করেন ৭০-এর দশকে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ। আরও অনেকের মতো কবি মতিন বৈরাগীও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার চেতনায় দেশ গড়ার। স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজ বদলের। স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যের-সুন্দরের। পেছনের ফেলে আসা যুগযন্ত্রণার বিপরীতে একটি সাহসী আত্মানুসন্ধানী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন মতিন বৈরাগী। তাই তাঁর কবিতায় দেখা যায় জাগরণের ডাক; এক দুর্নিবার স্বপ্নের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলার আহ্বান। যেখানে হতাশা, যেখানে অসহায়তা সেখানেই প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার যূথবদ্ধ সাহসী উচ্চারণ।
এ তো গেল ভাবনার দিক আর বিষয়ের দিক। কবিতা শুধু তো ভাব নয়। কবিতা শব্দের ভেলায় উড্ডীয়মান ভাবের উপরিকণ্ঠে এক ভাসমান বোধ। সেখানে শব্দকে এফোঁড়- ওফোঁড় করে গাঁথতে হয় কবিতার মালা, নির্মাণ করতে হয় কবিতার শরীর। সেখানেও তিনি অনন্য। সেখানেও নিজস্ব এক কবিতা-ভাষা তৈরি করে করে তাঁর কাব্যময় দীর্ঘ পথচলা। অনুপ্রাসের ও বিশেষণের শিল্পময় অবগাহন সেখানেও।
কবি মতিন বৈরাগীর বিশ্বাস, উচ্চারণ ও মনোবীক্ষণের একটি ধারণা পাওয়া যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম থেকেও। বিষণ্ণ প্রহরে দ্বিধাহীন (১৯৭৭), কাছের মানুষ পাশের বাড়ি (১৯৮০), খরায় পীড়িতস্বদেশ (১৯৮৬), আশা অনন্ত হে (১৯৯২), বেদনার বনভূমি (১৯৯৪), অন্তিমের আনন্দ ধ্বনি (১৯৯৮), অন্ধকারে চন্দ্রালোকে (২০০০), দূর অরণ্যের ডাক শুনেছি (২০০৫), স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার গল্প (২০০৭), অন্য রকম অনেক কিছু (২০০৮), খন্ডে খন্ডে ভেঙে গেছি (২০১২) এবং দুঃখ জোয়ারের জল¯্রােত (২০১৪), প্রিয় হয়ে বাজে (২০১৫) এবং এই বছর প্রকাশের অপেক্ষায় (চলো ভেঙে ফেলি ২০১৮) এ ছাড়া রয়েছে নির্বাচিত, নির্বাচিত কবিতা, [বর্ধিত সংস্করণ পরিম-িত] শ্রেষ্ঠ কবিতা, কাব্য সমগ্র [পরিম-িত বর্ধিত সংস্করণ] রয়েছে যৌথ সম্পাদনায় ‘গোল্ডেন রিলম অব পোয়েট্রি’ সিলেক্টেড পোয়েমস [ইংরেজী ভার্সন] কবি মতিন বৈরাগী তাঁর বইয়ের ভেতরে প্রবেশের আগেই পাঠকের জন্য সম্ভাব্যকাব্য-ভাবনাভূমি তৈরি করে দেন; কল্পনায় একটি গোষ্ঠীগ-ির মধ্যে পাঠককে আবদ্ধ করে রাখেন।
এ রকম অনুপন্থী ভাবনায় পাঠককে নিরন্তর ঠেলে দেয়ার পেছনে সম্ভবত দুটো দিক থাকে। প্রথমত, সীমাবদ্ধ ও পূর্ব ভাবনার মনোকেন্দ্রভূমিতে প্রোথিত কবির মূল্যায়ন অনেকাংশেই পৌনঃপুনিকতার গ্রাসে হয়ে পড়ে ক্লান্ত ও সম্ভাবনাহীন, যেখানে বহু ব্যবহারে কাব্য ও শিল্পভাষা হয়ে পড়ে চর্বিতচর্বণ ও শিল্পসুষমাহীন; এটা সৃজনকর্মের সঙ্কোচনের দিক। দ্বিতীয়ত, আপন বেদনা ও আকাক্সক্ষাকে সমষ্টির মধ্যে পৌনঃপুনিকভাবে সম্প্রচার করে সৃষ্টি করা যেতে পারে দ্রোহ ও সম্ভাবনার দৃঢ় পলিভূমি; এটা অগ্রগতির দিক, অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের দিক। কবি মতিন বৈরাগী তাঁর কবিতা নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কাব্যভাষার এমন একটি ধারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন দীর্ঘদিনের কবিতাচর্চায় যেখানে অনুপন্থী কোন ভাবনাই শিল্পের পরিপন্থী হয় না, পৌনঃপুনিকতা দোষে দুষ্ট হয় না, হয়ে পড়ে না ক্লান্তিকর ও স্থবির।
বরং কবি মতিন বৈরাগীর প্রতিটি কবিতাই যেন বিশ্লেষণ, বিশেষণ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার ইত্যাকার শব্দপ্রয়োগে পাঠকের একটি ভাবনাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে, একটি চিত্রকর্মের পাশাপাশি স্থাপন করে আরেকটি সম কিংবা বিপরীত চিত্রকর্ম, একটি সংযোগ সাঁকো স্থাপিত হয় অন্ধকার ও আলোর মধ্যে। এসব কিছু ছাপিয়ে কবি মতিন বৈরাগীর নিজস্ব ও একান্ত যে কবিতাভাষা-তা যেন দ্রোহ ওঅভিঘাতের মাধ্যমে সমাজ সঙ্কট থেকে উত্তরণের সুস্পষ্ট এক দিক-নির্দেশনা।
এতো গেল তাঁর চিন্তার অগ্রসরতা। কবিতা নির্মাণশৈলীতেও তিনি অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। শুধু যতি ও ছেদের ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতার মাধুর্য বৃদ্ধি নয়, একমাত্র কবি মতিন বৈরাগীর পক্ষেই মনে হয় সম্ভব এবং তারপর এ শব্দ দুটি দিয়ে একটি অনবদ্য কবিতা নির্মাণ শুরু করা।
এবং তারপর চারদিকে ভাঙচুর-পতন ধ্বনি, মনে হলো/ এক পাহাড় ধসের মুখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। পড়তে পড়তে মনে হবে কতদিন থেকে যেন পড়ছি কবিতাটি। কবি বলে যাচ্ছেন পাহাড় ধসের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পতন-উন্মুখ সময়ে। একটু পরেই সব থেমে যাবে। ঠিক মৃত্যুপোত্যকায় দাঁড়ানো কোন পাংশুল মুখের বর্ণনা যেন। পেছনের সব কিছু মনে পড়ছে তাঁর। সে পেছনের কথাগুলোর সমষ্টিক নাম ইতিহাস, আর ব্যক্তিক নাম স্মৃতি। কবি মতিন বৈরাগী তাঁর কবিতার মাধ্যমে পাঠককে সে ইতিহাস ও স্মৃতির গলিপথ ধরে ধরে পৌঁছে দিচ্ছেন ভবিষ্যতের কোন সম্ভাবনার এভিন্যুয়ে; নিঃসরণের ক্লীবতার আচ্ছন্নতা থেকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছেন আশার সলতে জ্বালিয়ে। এ শুধু একটি কবিতা কিংবা একটি কাব্যের কিছু কবিতা নয়, বাংলাদেশের কবিতায় সামাজিক উত্তরণের এ দায়বদ্ধতার ডাক কবি মতিন বৈরাগী দিয়ে যাচ্ছেন চার দশকের অধিক কাল ধরেই।
সেই দ্রোহের ও দ্রোহের কবি, বাংলা কবিতায় অনিবার্য হয়ে ওঠা কবি- মতিন বৈরাগীর আজ ৭১তম জন্মদিন। সমাজ আজও বড় বেশি পতন-উন্মুখ, চিত্ত ও বিত্ত আজ বড় বেশি শৃঙ্খলিত। এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ও সময়ে কবি মতিন বৈরাগীকে আজ আরও বেশি প্রয়োজন। কবি আরও অনেকদিন সুস্থ থাকুন, কাব্যময় থাকুন। ‘ওপাশে ঝলমলে এক সূর্য সবুজের জমিনে উড়ছে ॥ আহা, কী-যে অদ্ভুত বেঁচে থাকা।’ নিজের কবিতার সেই পঙ্ক্তির মতোই ‘আহা’ ও আনন্দে বেঁচে থাকুন কবি নিজের স্বপ্নের স্বদেশে। শুভ জন্মদিন, কবি। [ভজন সরকার, প্রকৌশলী, কবি ও লেখক, থাকেন কানাডায়]
শীর্ষ সংবাদ: