ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাজকিয়া নুর মুন

অবশেষে বিদায় বললেন আশিষ নেহরা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৮ নভেম্বর ২০১৭

অবশেষে বিদায় বললেন আশিষ নেহরা

‘একজন পেসার হয়েও এত চোট-আঘাত নিয়ে এত দিন খেলে চলেছে, এতেই বোঝা যায় ক্রিকেটটাকে ও কত ভালবাসে। লড়াকু মানসিকতা, ইস্পাতসম দৃঢ় মনোবল যা চাইবেন, নেহরার চরিত্রে পেয়ে যাবেন। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষমতা ছিল ওর। আর একটা কথা বলব, নেহরার মতো টিম ম্যান আর হয় না। এই কথাটা আমি জোর দিয়ে বলছি। যখনই অধিনায়কের প্রয়োজন হয়েছে, তখনই নিজের সেরাটা দিয়ে বল করেছে।’ সাবেক সতীর্থ আশিষ নেহরা সম্পর্কে কথাগুলো বলেছেন ভারতীয় গ্রেট সৌরভ গাঙ্গুলী। ১ নবেম্বর ’২০১৭ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি২০র মধ্য দিয়ে ৩৮ বছর ১৮৬ দিন বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন আশিষ নেহরা। এর মধ্য দিয়ে দেড় যুগের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন তুখোড় বাহাতি পেসার। চোটের সঙ্গে বহুবার লড়াই করেছেন; ফর্ম হারিয়েছেন; কখনও দল থেকে বাদ পড়ে আবার দুর্দান্ত প্রতাপে ফিরেও এসেছেন। ১৯৯৯ সালে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন নেহরা। ২০০১Ñএ ওয়ানডে অভিষেক। ভারতের জার্সিতে ১৭ টেস্টে ৪৪, ১২০ ওয়ানডেতে ১৫৭ ও ২৭টি-২০ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৪ উইকেট। ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারে অনেক ম্যাচ মিস করেন তিনি। নেহরার সেরা কয়েকটি বোলিংয়ের কীর্তি (১) ৬/২৩, ডারবান ২০০৩ : বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং স্পেল ছিল নেহরার। এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা স্পেলগুলোর মধ্যে অন্যতম ২৩ রানে ৬ উইকেট নেওয়ার সেই কীর্তি। (২) ৬/৫৯, কলম্বো ২০০৫ : ইন্ডিয়ান ওয়েল কাপের ফাইনালে নেহরার এই বোলিং চিরকাল মনে রাখবেন ভারতীয় সমর্থকরা। ম্যাচ হারলেও নেহরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের জার্সি গায়ে দীর্ঘদিন খেলার জন্যই এসেছেন তিনি। (৩) ৪/৩৫, জোহানেসবার্গ ২০০৩ : নেহরার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ম্যাচ ছিল ভারত বনাম শ্রীলঙ্কার এই ম্যাচ। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে আগে ব্যাট করে ২৯২ রান তুলেছিল সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত। জবাবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা নেহরা ৩৫ রানে তুলে নেন ৪ উইকেট। তার পেস আক্রমণের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি লঙ্কানরা। (৪) ৪/৪০, ডাম্বুলা ২০১০ : মূলত সেবার নেহরার এই স্পেলের জন্যই ২০১০ এশিয়া কাপ ঘরে তুলতে পেরেছিল ভারত। দুর্দান্ত বোলিংয়ের পথে সেদিন কুমার সঙ্গাকারা, এ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ, মহেলা জয়াবর্ধনের মতো বিশ্বসেরা সব ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঘরের ছেলের বিদায় উপলক্ষে দিল্লিজেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামের একটি প্রান্তের নামকরণ করা হয় আশীষ নেহরা স্ট্যান্ড। হোম ভেন্যুতে বিদায়ের দিনে তিনি সেই প্রান্ত থেকেই বল করেছেন নেহরা। নিজের নামে করা প্রান্ত থেকে বল করে বিদায় নিয়েছেন ক্রিকেট থেকে। তার আগে ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র একজন বোলার এমন মর্যাদা পেয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের পেসার জেমস অ্যান্ডারসন। অবশ্য জানা যায় এটি মাত্র একদিনের জন্য করা হয়েছিল। এবং সেটা আশীষ নেহরাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই। সেদিন ম্যাচ জয়ের পর অধিনায়ক বিরাট কোহলি বলেন, ‘নেহরার জন্যই এ ম্যাচ জিততে চেয়েছিলাম আমরা। এ বিদায়ী সংবর্ধনা তাকেই মানায়। ১৯ বছর ভারতীয় ক্রিকেটের পেছনে বড় বড় অবদান সে রেখেছে। সে এখন তার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবে। তবে আমরা তাকে মিস করব এবং তার জন্য শুভ কামনা রইল।’ প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক অধিনায়ক উইলিয়ামসন। তিনি বলেন, ‘দুর্দান্ত এক ক্যারিয়ারের জন্য নেহরাকে অভিনন্দন জানাই এবং তার সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করছি।’ ক্রমশ উপমহাদেশীয় ক্রিকেটারদের স্বাভাবিক অবসরের বিষয়টি যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে! শহীদ আফ্রিদি, বীরেন্দর শেবাগের মতো বড় সব তারকাদেরও বিতর্ক আর বিবাদের মধ্য দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। আশিষ নেহরা সেক্ষেত্রে কিছুটা ভাগ্যবান বৈকি। তবে ভারতীয় পেসারের ক্ষেত্রেও ঝামেলা বাঁধিয়েছিলেন নির্বাচক বোর্ডের প্রধান এম এস কে প্রসাদ। তিনি বলেছিলেন, একাদশে তার অবস্থান নিশ্চিত নয়। অথচ অনেক আগেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ খেলে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন নেহরা, সেই মোতাবেক তাকে সিরিজের স্কোয়াডেও রাখা হয়। দিল্লিতে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলা নেহরা তাই ক্ষোভ গোপন করেননি, ‘নির্বাচক প্রধানের সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি। আপনাদের কাছেই (সংবাদ কর্মী) ওর বক্তব্য জেনেছি। আমি শুধু এটা বলতে চাই যখন খেলা শুরু করেছিলাম তখনও নির্বাচকদের অনুমতি নিইনি। আবার যখন খেলা ছাড়লাম, তখনও নির্বাচকদের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি!’ বলেন তিনি। তা হলে ‘ফেয়ারওয়েল ম্যাচ’ কী ভাবে হল? ‘আমি কখনও ফেয়ারওয়েল ম্যাচের কথা বলিনি। ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পরে আমি রাঁচীতে পৌঁছেই বিরাটের সঙ্গে কথা বলি। ওকে আমার অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলি। শুনে বিরাট প্রথমেই বলেছিল, ‘তুমি ঠিক করে ফেলেছ? তুমি আইপিএল খেলতে পারো। এমনকী, কোচ কাম প্লেয়ার হিসেবেও খেলতে পারো।’ ওকে বলে দেই, না। আমি পুরোপুরি অবসর নেব। কোনও নির্বাচক নয়, আমি বিরাট এবং কোচ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।’ এরপর নেহরা নেহরা পরিষ্কার জানিয়েছেন, তাঁর ভাগ্য ভাল বলেই তিনি দিল্লিতে ঘরের মাঠে জীবনের শেষ ম্যাচটা খেলতে পারলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমার ভাগ্য ভাল বলেই এটা ঘটল। আমি কোনও রকমের ফেয়ারওয়েল ম্যাচ চাইনি। হয়তো ঈশ্বর আমাকে এ ভাবেই আমার সারা জীবনের পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিলেন। আর আমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচের মধ্য দিয়ে ভারত প্রথম বারের মতো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ জেতায় আরও বেশি ভাল লাগছে। কোহলির নেতৃত্বে এই দলটা আরও ভাল করবে।’ নেহরার বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে নির্বাচক প্রধানই বেশি ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন, সিরিজের আগে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘নেহরা দিল্লিতে খেলবে কি না, ঠিক নেই।’ তিনিও এও জানিয়েছিলেন, নেহরাকে তাঁরা শুধু নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্যই ভাবছেন। অর্থাৎ স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, নিউজিল্যান্ড সিরিজই মোটামুটি শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ হতে চলেছে নেহরার। তা তিনি অবসর নিন বা না-ই নিন। বিদায়ী ম্যাচ পাওয়ার পরও তাই প্রসাদের দিকে নেহরার এমন বাউন্সার! তবে দিল্লী জেলা ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন ঠিকই ঘরের ছেলেকে রাজকীয় বিদায় জানাতে ভুল করেনি। বর্ণময় ক্রিকেট জীবনে ভারতীয় ক্রিকেটের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী নেহরা। সাফল্য যেমন তার মাথায় মুকুটের মতো বসেছে, কখনও আবার ব্যর্থতার গ্লানিও সহ্য করেছেন বাঁ হাতি এই পেসার। তবে সব মিলিয়ে তিনি খুশি। তবুও বিদায়বেলায় কেবল একটিমাত্র আক্ষেপ থেকে গেল তার! সম্প্রতি সে আক্ষেপের কথাই তিনি জানিয়েছেন ভারতের একটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। নেহরা বলেন, ‘আমার ক্যারিয়ারের যাত্রাপথটা ছিল দুর্দান্ত। আমি সব দিক থেকেই খুশি। কেবল একটাই আফসোস আছে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জোহানেসবার্গের সেই বিকেলটা যদি বদলে দিতে পারতাম!’ উল্লেখ্য, ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত হেরে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছে। প্রথমে ব্যাট করে ৩৫৯ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। বল হাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন নেহরা। ১০ ওভারে ৫৭ রান দিলেও কোন উইকেট পাননি তিনি। ভারতের ইনিংস শেষ হয়ে গিয়েছিল ২৩৪ রানেই। সেই ব্যর্থতা এখনও কুরে কুরে খায় নেহরাকে।
×