ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপের যে স্মৃতিগুলো ভোলেন না ম্যারাডোনা...

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৮ নভেম্বর ২০১৭

বিশ্বকাপের যে স্মৃতিগুলো ভোলেন না ম্যারাডোনা...

আর্জেন্টিনার সুপার স্টার ডিয়েগো ম্যারাডানা- বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর মন কেড়ে নিয়েছিলেন। অসাধারণ ফুটবলশৈলিতা দিয়ে বন্ধু কিংবা শত্রু সবাইকে গেঁথেছিলেন এক সুতোয়। সকলে ম্যারাডোনার ভক্ত। কিংবদন্তি এ তারকা এখন পর্যন্ত বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের মনে বসত করেন। তার দুর্দান্ত নৈপুণ্যগুলো এখন পর্যন্ত চোখে ভাসে সকলের। যারা সরাসরি দেখেননি তারাও অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখেন ভিডিও ফুটেজ। বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সেরা ম্যারাডোনা। তিনি মাঠে থাকাই যেন একেকটা জীবন্ত ইতিহাস। আর্জেন্টিনার একমাত্র বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের মহানায়ক ম্যারাডোনা। কিন্তু নিজের কিছু বিশ্বকাপ স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারেন না তিনি। মাঠে থাকার সময় সেই সময়গুলোতে নিজের আবেগ, অনুভূতি এবং স্বগতোক্তিগুলো এখনও অম্লান হয়ে আছে তার মনে। সেই স্মৃতিগুলোই বিষদভাবে বর্ণনা করেছেন সম্প্রতিই এক সাক্ষাতকারে। সেই সাক্ষাতকারে ম্যারাডোনার সেরা ৫ বিশ্বকাপ স্মৃতি নিয়েই এবারের আলোচনা- ১৮ জুন, ১৯৮২ বিশ্বকাপে প্রথম গোল আর্জেন্টিনা ৪-১ হাঙ্গেরি ॥ আমি শুধু চেয়েছিলাম যে বলটা জালে ঢোকাতে, এর বেশি কিছু না। আমরা বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটা হেরে গিয়েছিলাম এবং সে কারণে এই ম্যাচটার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়েছিলাম। আমি অনূর্ধ-২০ বিশ্বকাপে গোল করেছিলাম কিন্তু সেটাকে এই অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন না যখন মূল বিশ্বকাপে গোল করবেন। বিষয়টা এ রকম যে আপনার মা এসে আপনাকে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই সকালের নাস্তা প্রস্তুত করে দিলেন। এটা খাঁটি সুখ, যেমনটা আমি আমার মাকে চুমু খাওয়ার সময় পাই। সে সময় অনেকগুলো বিষয় মাথার মধ্যে কাজ করছিল। ২ জুলাই, ১৯৮২- বাতিস্তাকে লাথি মেরে লালকার্ড, আর্জেন্টিনা ১-৩ ব্রাজিল ॥ আমি এ বিষয়টি নিয়ে এক বছর পর বাতিস্তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং একই কথা আমি ফ্যালকাওকে বলেছিলাম। ৩-১ ব্যবধান হওয়ার পর তারা আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করতে শুরু করেছিল। আর আমি বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারি না পরাজয়। সে আমাকে বলেছিল, ‘না, ডিয়েগো। এটা শুধুমাত্র ফুটবলের বিষয় যা আমরা ভেতরে ভেতরে অনুভব করি।’ কিন্তু আপনারা কি বিষয়টি বুঝতে পারছেন? যদি তিন গোলে আমরা এগিয়ে থাকতাম এবং আমরা গাইতাম, ‘ওলে, ওলে, ওলে!’ এর পাশাপাশি এদিক-সেদিক বলে লাথি মারতাম এবং পাগলামি করতাম সেটা নিশ্চিতভাবে যার শিরায় রক্ত প্রবাহিত হয় গরম হয়ে যাবে। কিন্তু আমি আসলে ভুল খেলোয়াড়কে লাথি হাঁকিয়েছিলাম। সেটাই এখন অবিশ্বাস্য লাগছে। ২২ জুন, ১৯৮৬ গোল অব দ্য সেঞ্চুরি, আর্জেন্টিনা ২-১ ইংল্যান্ড ॥ আমি আর কখনও এটার মতো গোল করিনি। আমি খুব কমই এমন গোল করেছি যেটা আমাদের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে কিন্তু এটা ছিল বিশ্বকাপ। সব মানুষের একটা বড় স্বপ্ন এটা। আমাদের সবার স্বপ্ন ছিল প্রতিপক্ষদের কাটিয়ে যাওয়া। বিশেষ করে পিটার শিলটনকে। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি না তিনি কি করেছিলেন। আমি জানি না কোন ভূত নাকি ইউএফও নেমে এসেছিল এবং তাকে নিয়ে গেল। তিনি আমার জন্য গোলমুখটা একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আমি তাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম এবং সেটা হয়ে গেল। যখন আমি মাকে গোলটি টিভিতে দেখার সময় খেয়াল করলাম তখন তিনি বলছিলেন, ‘এটা দেখতে আমি ক্লান্ত হইনা কখনও।’ আমিও তাই বার বার মাকে ডেকে বলতাম, ‘মা আসো গোলটা আবার দেখো!’ তিনি আমাকে বলতে নিজের ছেলেকে গোল করতে দেখে পুরোপুরি ভারমুক্ত ও ফুরফুরে মনে হয় তার। তিনি বলতেন,‘তুমি যদি চলে যেতে চাও, যেতে পার। আমি গোলটা দেখা চালিয়ে যাব।’ ২৪ জুন, ১৯৯০ ক্যানিজিয়ার জাদু, আর্জেন্টিনা ১-০ ব্রাজিল ॥ ব্রাজিলিয়ানরা আলেমাওকে দোষারোপ করে গোলটির জন্য। কিন্তু আমি আসলে তাকে খুবই দ্রুতগতিতে কাটিয়ে গিয়েছিলাম। আমি এটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি এবং আমার সামনে ছিল দুঙ্গা তাকে ঠেকানোর জন্য নিজের কনুই ব্যবহার করেছিলাম। সুতরাং এটা আলেমাওয়ের দোষ নয়, দুঙ্গার। তিনি আমাকে চলে যেতে দিয়েছিলেন। যখন ক্যানিজিয়া গোল করল আমি ঈশ্বরকে এবং আমার মাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং ধন্যবাদ দিলাম বিশ্বের সকল সিদ্ধ পুরুষদের। ক্যানিজিয়া খুব বেশি উদযাপন করে না আনন্দটা। শুধু বাহু দুটি উঁচিয়ে তোলে। যেন এটা তেমন কোন ঘটনাই নয়। আমি যখন তাকে পরে সামনে পেলাম, বললাম, ‘শোনো এখন এখানে ঠা-া পরিবেশ, তুমি কি জানো আজ তুমি কি করেছো?’ সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল,‘হ্যাঁ, আমি গোল করেছি!’ কিন্তু আমি তাকে বললাম, ‘না, তুমি পুরো স্টেডিয়ামে নীরবতা এনে দিয়েছো।’ যখন ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমি ব্রাজিলিয়ানদের প্রতি সম্মান জানাতে তাদের জার্সিটা গায়ে দিয়েছিলাম। ওটা ক্যারেকার সঙ্গে বদল করেছিলাম আমি। সে আমার বন্ধু ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন আমরা ব্রাজিলকে ডাকাতি করেছি। কারণ, তারাই আর্জেন্টিনার চেয়ে ভাল ছিল এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তারা পুরো খেলায় আমাদের ঠেসে ধরেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা জিতে গেলাম। আর এ কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলা ফুটবল। ৩ জুলাই, ১৯৯০ জেঙ্গাকে ফাঁকি দেয়া, ইতালি ১-১ (৩-৪) আর্জেন্টিনা ॥ কিছুটা আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল এটা। কারণ, আমরা যখন পেনাল্টির জন্য যাচ্ছিলাম ইতালিয়ানরা আমাকে বলছিল যে তাদেরই জেতা উচিত। লুইজি ডি আগোস্টিনি এবং ওয়াল্টার জেঙ্গা আমাকে বলছিলেন যে ড্র কোনভাবেই তাদের জন্য সঠিক ফলাফল না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এমন একটি ম্যাচে এসব প্রশ্ন কোনভাবেই আসেনা। আসে কি? তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাদের মতো এবং আমারটা আমার মতো। আমি যুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে একটা পেনাল্টি মিস করেছিলাম। তাই যখন আমি মাঝ বৃত্ত থেকে শট নেয়ার জন্য গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম নিজেকেই বলছিলাম, ‘তুমি যদি এটা মিস কর তাহলে তুমি হবে অপদার্থ। তুমি যদি মিস করো তাহলে তুমি কাপুরুষ এবং নিকৃষ্ট হবে। তুমি কোনভাবেই সেসব লোকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পার না যারা তোমাকে ভালবাসে। মা, বাবা, আমার ভাইয়েরা এবং আর্জেন্টিনার মানুষ কেউ তোমাকে ক্ষমা করবে না।’ কিন্তু আমি জেঙ্গার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভাল শটটাই নিয়েছিলাম এবং লক্ষ্যভেদ করেছিলাম। আমিই ছিলাম সেই ব্যক্তি যে ইতালিয়ানদের নকআউট করে দিয়েছিল।
×