ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই ॥ প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয়

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই ॥ প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয়

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এখনও যেখানে দলে দলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে সেখানে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি রয়েছে আশা-নিরাশার দোলাচলে। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, নারকীয় তা-ব চলার পর নাফ নদীতে প্রতি দিনে-রাতে জোয়ার ভাটা হয়েছে। পক্ষান্তরে, রোহিঙ্গাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাখাইন রাজ্য। নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবিতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে অনেকের মৃতদেহ কূলে উঠে মাটি চাপা পড়েছে। আবার জোয়ার ভাটার টানে বহু লাশ মহাসমুদ্রে বিক্ষিপ্তভাবে ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তার কোন হদিসও নেই। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতার এমন ঘটনা নজিরবিহীন যা বিশ্বজুড়ে সর্বত্র আলোচনায় স্থান পেয়েছে। আওয়াজ উঠেছে রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ শক্তিশালী বিভিন্ন দেশের পক্ষে তাদের রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে দফায় দফায়। শক্তিশালী দু’তিনটি দেশ ছাড়া বিশ্ববিবেক এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও মিয়ানমার যেন এখনও উল্টো পথেই রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং তা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মন্থর করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে মিয়ানমার সরকার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সর্বশেষ মিয়ানমার সেনাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটররা যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ চেয়েছেন এবং অবরোধের কথা বলছেন, তার ফলাফল কি হবে সেদিকেই সকল মহলের অপেক্ষার নজর নিবদ্ধ হয়েছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকাই যেন এর সমাধানের গতিপথ বাতলে দিতে পারে-এমন আশা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের অপেক্ষার প্রহর অতিবাহিত হচ্ছে। এদিকে, সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের লাইনে রয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত নতুন করে তিন সহস্রাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। পদব্রজে বাংলাদেশ সীমান্তমুখী রয়েছে অগণন। যার সংখ্যা অর্ধলক্ষেরও বেশি বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। পরিস্থিতি এমন, অনুপ্রবেশের যেন শেষ নেই। অপরদিকে বিশ্বচাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ইতোমধ্যে নানা বক্তব্য দিয়েছে। এমনকি সেদেশের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচিও রাখাইন রাজ্য সফর করে গেছেন। ঝগড়া বিবাদ না করে সকলকে মিলে মেশে থাকার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। যা নিতান্তই হাস্যকর হিসেবে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। কেননা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে অথবা সেদেশের সেনাবাহিনী বা উগ্র মগ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে এমন কোন বড় ঘটনার জন্ম দেয়নি যাতে একেবারে সামরিক অভিযানের মাধ্যমেও গণহত্যা চালিয়ে তাদের দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হবে। আগামী ১৫ নবেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমার সফর করবেন। তার সফরকালে এবং সফরের পর মিয়ানমার সরকার কোন পথে এগোয় তাই এখন দেখার বিষয় হয়ে আছে বিশেষজ্ঞ মহলগুলোতে। তবে মিয়ানমারের পক্ষে আগেভাগেই বলে দেয়া হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেদেশের সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধ আরোপ করা হলে তাতে সেদেশে বেসামরিক সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এ অবনতি বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। ওপারের সূত্রগুলো বলেছে, রাখাইন রাজ্যে যাই ঘটুক না কেন তা সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সামরিক অভিযান শুরু করে রোহিঙ্গা নিধন চালানোর পর সুচি সরকার যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা কোনভাবে ধোপে টিকে না। কেননা, রোহিঙ্গারা বাঙালী নয়, বাংলাদেশীও নয়, জঙ্গীও নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের এসব সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া নাগরিকত্ব বহু আগে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গতবছর রোহিঙ্গাদের সেদেশে বসবাসের অন্যান্য যেসব প্রমাণাদি ছিল তাও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণে সেদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বসবাসের সর্বশেষ আশা-ভরসাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর যে কারণে বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান, দমন নিপীড়ন তেমন একটা না থাকলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা আর সেখানে থাকা নিরাপদ মনে না করে দলে দলে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। এদিকে, সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী ৩ হাজার ১শ’ রোহিঙ্গা উখিয়ায় কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বিজিবি’র তত্ত্বাবধানে এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকতে সক্ষম হলেও তাদের এখনও নিরাপদ আশ্রয় মেলেনি। তবে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এসব রোহিঙ্গা খাদ্য, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মানবিক সাহায্য সহযোগিতা করছে। বিজিবি সূত্রে আরও জানা গেছে, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত আসা ৩ হাজার ১শ’ রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। যাতে এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে না পারে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা গত সোমবার রাত থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের দেয়া কাঁটাতারের বেড়া সংলগ্ন ওপারে মেদি এলাকায় খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়ে অবস্থান করছিল। অভুক্ত ঐসব রোহিঙ্গা খাদ্য, ওষুধ ও থাকার জায়গা না পাওয়ায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অতি সহজভাবে এপারে ঢুকতে না পারায় ওপারে তাদের ২ দিন ২ রাত অবস্থান করতে হয়েছে। বুধবার রাতে জড়ো হওয়া এসব রোহিঙ্গারা জীবন বাজি রেখে নাফ-নদী সাঁতরিয়ে আঞ্জুমানপাড়ার নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। রাতের অন্ধকারে ঐসব রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাফ-নদী পার হওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হলে স্থানীয় বিজিবি’র সদস্যরা তাদের নিরাপত্তায় এগিয়ে যায়। রোহিঙ্গারা যাতে নো ম্যানস ল্যান্ডের মধ্য থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য তাদের নজরদারিতে রেখেছে বিজিবি সদস্যরা। এ সময় রোহিঙ্গারা চিংড়ি ঘেরে বেড়িবাঁধের ওপরে আনাচে-কানাচে শুকনা জায়গায় আশ্রয় নিয়ে দিন কাটিয়েছে। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাদের ওষুধ, খাদ্য ও মানবিক সেবা দিয়ে সহযোগিতা করলেও অধিকাংশ বয়োবৃদ্ধ ও শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। বুচিদং কাওয়ারখোপ থেকে আসা ছৈয়দ আলম জানান, তারা ত্রাণ সামগ্রী, খাদ্য ও ওষুধ পেয়েছে, তবে থাকার জায়গা না পাওয়ার কারণে অসুস্থ ছেলে-মেয়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হয়েছে। একই গ্রামের স্বামীহারা তসিবা খাতুন জানান, তিনি তিন সন্তান নিয়ে ৭ দিন পাহাড়ী পথ বহু কষ্টে অতিক্রম করে কাতর হয়ে পড়েছেন। সুচির বক্তব্য হাস্যকর ॥ রাখাইন রাজ্যে গত দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা বিরোধী তা-বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, প্রতিবাদ ও গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানালেও একটিবারের জন্য সুচি বিষয়টি আমলে নেননি। উপরন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন তিনি। হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, উচ্ছেদ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে উত্তর রাখাইন যখন রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়েছে, তখনই গত বৃহস্পতিবার মংডু ও রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সফরে যান সুচি। কিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। দালালসহ ৪৮ রোহিঙ্গা আটক ॥ দালাল চক্রের ২ সদস্যসহ ৪৮ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষকে আটক করেছে উখিয়া থানা পুলিশ। দালালচক্রের নিয়ন্ত্রণে এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজার রওনা হয়েছিল। খবর পেয়ে উখিয়া থানা পুলিশ উখিয়া সদর স্টেশনে যাত্রীবাহী তল্লাশি চালিয়ে এসব রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আর এতিম শিশুর সংখ্যা বাড়ছে ॥ আগের মতো অনুপ্রবেশের স্রোত না থাকলেও প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে শুক্রবার ৩ নবেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার। প্রতিদিন অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
×