ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মা ফিরে এলেও এখনও অজানা অন্ধকারে মেয়ে

সৌদি আরবে কিশোরী রুপার দুঃসহ বন্দী জীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৫ নভেম্বর ২০১৭

সৌদি আরবে কিশোরী রুপার দুঃসহ বন্দী জীবন

আজাদ সুলায়মান ॥ অষ্টাদশী রুপা ছয় মাস ধরে বন্দী সৌদি আরবের কোন এক শহরে। মেডিক্যাল ভিসায় তাকে পাঠানোর আশ্বাসে টাকা নেয়া হলেও এখনও কাজ করানো হচ্ছে বাসায় বন্দী রেখে। কাজ হলেও- করত। কিন্তুু যে কাজ করানো হচ্ছে- ওই বাসায় তা বলতেও পারছেন না মুখে। বলতে পারছে না সামাজিকতার খাতিরে ‘আমাকে ওরা বাপ-বেটা পালাক্রমে যৌন নির্যাতন করে। দিনে বাপ রাতে বেটা। একথা মুখে বলার নয়।’ সর্বশেষ দিনকয়েক আগে মায়ের কাছে ফোন করেন রুপা। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, আমাকে যে করেই হোক দেশে ফিরিয়ে নাও। নইলে আমার লাশ যাবে বাড়িতে। এখানে কাজের নামে ....। একথা বলার মতো নয়। রুপা কোথায় কিছুই বলতে পারছে না। সৌদি আরবের কোন্ শহরের কোন্ বাসায় তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে তা নিজেও যেমন বলতে পারছে না তেমনি তার বাবাও জানতে পারছেন না। শুধু একটা ফোন নম্বর নিশ্চিত হয়েছেন বাবা, সেটা হলো -০৫০৪৯৩৬০০২। সর্বশেষ এই নম্বর থেকে ফোন করেছিল রুপা। এখন এটাতেও মিলছে না তাকে । এই যখন অবস্থা তখন গরিব বাবা-মায়ের পক্ষে কি আর করা। ঘরে তো টাকাপয়সাও নেই। জমিজিরাত যেটুকুন ছিল, বিক্রি করেই তো রুপা ও তার মাকে একযোগে সৌদিতে পাঠানো হয়েছিল। পাঠানোরও ইচ্ছে ছিল না। পাশের গ্রামের দুই দালালের প্রলোভনে ৫ লাখ টাকা খরচ করে পাঠানো হয় সৌদিতে। ঢাকার বনানীর ৮১ এয়ারপোর্ট রোডের আল রাইয়েন ইন্টারন্যাশনালের (আরএল নং ১১২৫) মাধ্যমে সৌদিতে পাঠানো হয়। গত ১০ জুলাই তাকে পাঠানো হয় মেডিক্যাল ভিসায়। তার স্বপ্ন ছিল- মেয়ে হলেও হাসপাতালে আয়া বা অন্য কোন পরিশ্রমের কাজ করতেও দ্বিধা নেই। ঠিকমতো বেতন দিলে চলবে। মেডিক্যাল ভিসার কথা শুনেই তো বাবা এত টাকা খরচ করে মা-মেয়েকে একত্রে সৌদিতে পাঠাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এমন দুঃসহ জীবন যে তাদের কপালে অপেক্ষা করছে তা কল্পনাতীত। প্রথম দিনেই তাকে নেয়া হয় এক বাসায়। তখন জানতে চান এখানে কেন। সেখানকার বাংলাদেশী দালালের জবাব, এখানেই কটা দিন থাকতে হবে। বাসার কাজেই তাকে আনা হয়েছে। একথা শুনে মাথায় হাত। এ নিয়ে চলে তর্কবিতর্ক। কোন লাভ হয়নি। ওখানেই সর্বনাশা জীবনের শুরু। একরাতও পার হয়নি। এরই মধ্যে তার সব কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় তার অভিশপ্ত জীবন। রুপা যা বলতে চায় ফোনে তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি এখন যৌনদাসী। ওই বাসার বাপ-বেটা পালাক্রমে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। রুপা কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। ছয় মাস ধরেই রুপা সেখানে বন্দী। তাকে আনতেও পারছে না তার বাবা-মা। এমনকি সেখানে কোথায়, কোন্ বাসায় আছে সেটা পর্যন্ত জানতে পারছে না বাবা-মা। রুপার মায়ের কাহিনী তো আরও ভয়ঙ্কর। মা-মেয়েকে এক সঙ্গে সৌদিতে পাঠিয়ে হঠাৎ বড়লোক হতে চেয়েছিলেন মোস্তফা। দালাল তাকে এতটা প্রলুব্ধ করেছিল যে তা ভেবে দেখারও সময় পাননি তিনি। মেডিক্যাল ভিসায় পাঠানো হবে হাসপাতালে আয়ার কাজ, বেতন মাসিক ২৫ হাজার। মা-মেয়ে মিলে মাসে সব খরচ করেও ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে পারবে। এমনসব লোভনীয় অফার প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি তিনি। যে কারণে জমিজিরাত যা ছিল বিক্রি করে দালালের হাতে গুঁজে দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে রুপার বয়সের মেয়েকে কিভাবে মাত্র ৯০ দিনের ভিসায় কোন ধরনের কাজের নিশ্চয়তা ছাড়াই সৌদি আরবে পাঠানো হলো ? তাকে এভাবে বন্দী রেখে পাশবিক নির্যাতন চালানোটা রীতিমতো মানব পাচার। কর্মসংস্থান ও অভিবাসনের নামে এভাবে কিশোরীদের বিদেশে পাঠিয়ে বাসা-বাড়িতে কাজ করানোটা অবশ্যই ভয়ঙ্কর অপরাধ। জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোই কিভাবে এ ধরনের ভিসায় অনুমোদন দিয়ে মা-মেয়েকে সৌদিতে পাঠিয়েছে তা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার লক্ষিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা। গরিব মানুষ। সামান্য কিছু জমিজিরাত। সংসার বলতে স্ত্রী মমতাজ (৩৫), চার মেয়ে ও এক ছেলে। দ্বিতীয় মেয়ে রুপা আখতার (১৮)। সংসারের টানাপোড়নের সুযোগটাই নিয়েছে পাশের গ্রাম বরাটিয়ার দুই দালাল বিপ্লব ও রইছ উদ্দিন। তারা মোস্তফাকে ভাগ্য গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তার স্ত্রী মমতাজ ও মেয়ে রুপা আখতারকে সৌদিতে পাাঠিয়ে দিলেই আর অভাব থাকবে না। ঘুরে যাবে ভাগ্যের চাকা। এজন্য মাত্র লাখপাঁচেক টাকা হলেই চলবে। সৌদিতে মেডিক্যাল ভিসায় কাজ, বেতন জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা, থাকা-খাওয়া ফ্রি। বেশ নিরাপদেই থাকবে। এমন আশ্বাসেই মোস্তফা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেয় দুই দালাল বিপ্লব ও রইছ উদ্দিনের কাছে। তারা সেই টাকার অর্ধেক রেখে বাকিটা ঢাকার বনানী ৮১ এয়ারপোর্ট রোডের আল রাইন নামের একটি রিক্রুটিং অফিসের মালিক বাবুলের কাছে জমা দেয়। বাবুল কিছুদিন পর গত ১০ জুলাই মাত্র ৯০ দিনের ভিসায় প্রথমে রুপাকে পাঠায় সৌদি আরব। রুপা আখতারের ভিসার নম্বর ই-২৩৩৮১৩২৩৫, এস-২৬৬৯৮০৮৮। মাত্র পনেরো দিন পর ২৫ জুলাই তার মা মমতাজকেও পাঠায়। তার ভিসার নম্বর ই-২৩৩৮৮১৭২৫-এস ২৬৬৯৮০৮৭। এদের পাঠিয়ে মোস্তফা যখন সুখের প্রহর গুনছিলেন, সৌদি রিয়ালের অপেক্ষায় ছিলেন তখনই আসে একটি দুঃসংবাদ। একদিন স্ত্রী মমতাজ তাকে ফোন করে জানান, তাকে মেডিক্যালের কাজের কথা বলে প্রতারণা করা হয়েছে। প্রথম দিনেই এক বাসায় নিয়ে কাজে লাগানো হয়। এর প্রতিবাদ করলে সেখানে এক বাংলাদেশী দালাল হুমকি দেয়, বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হবে। মমতাজ তাতেও দমেননি। কাজ নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে ঢাকা থেকে আদম ব্যাপারি বাবুল তাকে ফোন করে হুমকি দেয়Ñযেই কাজ দেয়া হয়েছে সেটাই করতে হবে। নইলে লাশ পাঠানো হবে দেশে। এ ধরনের হুমকি দেয়ার কদিন পরই মমতাজকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর জামিনে বের হলে সেখানকার পুিলশ রিক্রুটিং এজেন্সি আল রাইনকে বাধ্য করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। গত ১৫ আগস্ট মমতাজ দেশে ফেরেন। তখন তিনি জানতে পারেন মেয়ে রুপার অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। সৌদির একটি বাসায় আটকে রেখে তার ওপর দিন-রাত নির্যাতন করা হচ্ছে। তার ওপর ওই বাসার মালিক ও মালিকের ছেলে পাশবিক নির্যাতন করছে। খাওয়া চাইলে বেদম প্রহার। দেশে ফিরতে চাইলেও মারপিট করা হয়। মমতাজের ভাষ্যমতে, আমি কোনক্রমে ফিরেছে জীবন নিয়ে। ওরা পদে পদে প্রতারণা ও জালিয়াতি করেছে। মেয়ে রুপার বয়স আঠারো হয়নি। তার বয়স ২৫ দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে সৌদিতে পাঠানো হয়েছে। সৌদির কোথায় রাখা হয়েছে তা পর্যন্ত জানতে দেয়া হচ্ছে না। আজ পর্যন্ত রুপাকেও জানতে দেয়া হয়নি। তাকে একটি বাসায় বন্দী রেখে এমনসব নির্যাতন করা হচ্ছে যা মুখে বলার মতো নয়। লুকিয়ে মেয়েটা অন্য একটা লোকের কাছ থেকে ফোন করে সর্বশেষ দিনপনেরো আগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করো, নইলে আমার লাশ যাবে দেশে। আমার সবই শেষ। ওরা আমাকে বন্দী করে জঘন্য কাজ করাচ্ছে। এ বিষয়ে রুপার বাবা মোস্তফা বলেন, আদম বেপারি সাঈফ উদ্দিন বাবুলের কাছে ফোন করে রুপাকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করেছি। তখন বাবুল উল্টো ফোন করে হুমকি দিয়েছে বেশি বাড়াবাড়ি করলে,সাংবাদিককে জানালে- তোর মেয়ের লাশ ফিরবে দেশে। চুপ থাকবি। কাউকে কিছু বলবি না। আদম বেপারি সাঈফ উদ্দিন বাবুলের মুখে এমন হুমকি পেয়ে বাধ্য হন আদালতের আশ্রয় নিতে। গত ২৭ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দা খানমের আদালতে একটি পিটিশন মামলা দাখিল করেন, যার নং ২৬৯/১৭। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল রাইয়েন ইন্টারন্যাশনাল নামক প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও নারী পাচার চক্রের বেপারি সাঈফ উদ্দিন বাবুল জনকণ্ঠকে বলেন, রুপার কিছু হলে তো সেটা আমাদের জানাবে। আপনাকে কেন জানাবে। তার কিছুই হয়নি। এসব বানোয়াট। আপনারা এটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। জানতে চাইলে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এটা এক ধরনের মানব পাচার। একে ৯০ দিনের ভিসায় তাকে সৌদিতে পাঠানো, তার ওপর মেডিক্যাল ভিসার কথা বলে বাসা-বাড়ির কাজে লাগানোটা প্রতারণা ও নারী পাচারের আওতায় পড়ে। সৌদিতে বাসা-বাড়ির কাজে পাঠাতে হলেও কমপক্ষে ২ বছরের ভিসায় পাঠাতে হবে। তা ছাড়া অভিভাবকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিদেশে জোরপূর্বক আটক করে তাকে দিয়ে কাজ করানো, নির্যাতন চালানো, বন্দী রাখার মতো অভিযোগ অবশ্যই গুরুতর। এ বিষয়ে র‌্যাব বরাবরাই কাজ করছে। বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে। কারণ এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এ ধরনের প্রতারণা, নারী ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করছে।
×