ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের হাতাহাতি, সংঘর্ষ জরুরী বিভাগের গেটে তালা দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ভোগান্তি

ঢামেকে রোগীর মৃত্যু নিয়ে তুলকালা ॥ ৩ ঘণ্টা চিকিৎসা বন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৩০ অক্টোবর ২০১৭

ঢামেকে রোগীর মৃত্যু নিয়ে তুলকালা ॥ ৩ ঘণ্টা চিকিৎসা বন্ধ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রোগীর মৃত্যু নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে চিকিৎসকরা জরুরী বিভাগের গেট বন্ধ করে দেন। সেখানে আনসার সদস্যদের পাহারা বসানো হয়। এতে প্রায় তিন ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল। এ সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে রোগীরা এলেও ভর্তির টিকেট কাউন্টার বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় রোগী ও স্বজনদের। অনেক রোগী দালালদের খপ্পরে পড়ে বাইরে ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা নেন। অবাঞ্ছিত এ ঘটনায় দেশের বৃহৎ এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অচল হয়ে পড়ে। এদিকে সংঘর্ষে তিন চিকিৎসক, চার আনসার সদস্যসহ দশজন আহত হয়েছেন। ঘটনার পর পুলিশ রোগীর তিন স্বজনকে আটক করেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম নাসিরউদ্দিন আহমেদ জানান, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চিকিৎসকদের হাতাহাতির ঘটনায় তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়েছে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কারণে জরুরী বিভাগে গেট বন্ধ করা হয়েছে। রবিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিট থেকে বন্ধ থাকা জরুরী বিভাগ আবার চালু হয় বিকেল ৫টার দিকে। তিনি জানান, চিকিৎসক ও আনসার সদস্যদের মারধরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। আগামীতে চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত নওশাদ (৫২) ঢামেক হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। রবিবার দুপুর দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নওশাদের মৃত্যু হলে তার স্বজনরা চিকিৎসকদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রোগীর স্বজনের হামলায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ শামিমুর রহমান, শাওন ও সায়েম নামে তিনজন আহত হন। এতে বাদল, শাহআলমসহ চারজন আনসার সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল হাসপাতালের ২ এর করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মোঃ রিয়াজ উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত সর্দার রমিজউদ্দিন আহত হন। চিকিৎসকদের হামলায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে দু’জন আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম নাসিরুদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনেন। এ সময় শাহবাগ থানা পুলিশ রোগীর তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সংঘর্ষের আশঙ্কায় জরুরী বিভাগের আশপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক নেতা ও কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে তার রুমে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে জরুরী বৈঠকে বসেন। বিকেল ৫টায় বৈঠক শেষে জরুরী বিভাগের গেট খুলে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে চিকিৎসাসেবা সচল হতে থাকে। ওয়ার্ডগুলোর চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুপুর ২টায় পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে তখন কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্স ও ব্রাদার মিলিত হয়ে হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। আধাঘণ্টা পর তারা জরুরী বিভাগের মূল গেট ও রোগী ভর্তি কাউন্টার বন্ধ করে দেন। এ সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শতাধিক গুরুতর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। এদের মধ্যে অনেক রোগী দালালদের খপ্পরে পড়ে বাইরে ক্লিনিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, জরুরী বিভাগে গেট ও ভর্তির টিকেট কাউন্টার বন্ধ থাকায় অনেক রোগীর স্বজনরা বহু আকুতি মিনতি করেও চিকিৎসকদের মন গলাতে পারেননি। ‘ভাই রোগীরে ভর্তি করান, দেরি করাইয়েন না, নইলে রোগী বাঁচব না। অনেক দূর থেকে আসছি। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে এভাবেই অন্তঃসত্ত্বা ঝুমুর মামা জাকির হোসেন চিৎকার আর কান্নাকাটি করে বলছিলেন। তার ভাগ্নি অন্তঃসত্ত্বা ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। ঝুমু কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত। ঝুমুকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল থেকে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কোন রোগীকে ভর্তি নিচ্ছে না। খুব বিপাকে পড়েছি। এ সময় অন্তঃসত্ত্বা ঝুমুর মামা জাকির হোসেন জানান, আমরা এখন এ রোগী নিয়ে কোথায় যাব? তারা আমাদের কষ্ট বুঝতেছে না। শুধু ঝুমুরের স্বজন নয়। এ রকম শতাধিক রোগী ও তাদের স্বজন ঢামেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে অবস্থান নিলেও রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করছে না কর্তৃপক্ষ। বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ ভবেরচর থেকে শ্বশুর আবদুল কাদিরকে নিয়ে এসেছেন জামাতা তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, তিনদিন ধরে প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ। মুন্সীগঞ্জে চিকিৎসা না পেয়ে ঢামেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে এলাম। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। রোগীর অবস্থা বেগতিক। তোফাজ্জলের স্ত্রী পারভীন বলেন, ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা বাবা ঝুটঝামেলা বুঝি না। চিকিৎসা নিতে এসে এমন বিপাকে পড়ব বুঝিনি। নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার এলাকা গর্ভবতী মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মা আলেয়া। তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, প্রসব বেদনা উঠেছে। মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। ভর্তি করা জরুরী। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। আল্লাহ জানে মেয়ে ও ওর অনাগত সন্তানের কী হবে? কুমিল্লা থেকে আসা ডায়রিয়া রোগী আসমা বেগমের বেহাল দশা হলেও হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না। ছেলে শামীম জানান, মায়ের অবস্থা খারাপ কিন্তু রোগীকে এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে দিচ্ছে না। ঢামেক হাসপাতালের সামনে আরও দেখা যায়- কিশোরগঞ্জ পাকুন্দিয়া থেকে আসা মানসিক রোগী পলি আক্তার সিএনজিতেই বসে আছেন, মামা মাহবুবুল ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু রোগীকে ভেতরে ঢুকতেই দিচ্ছেন না আনসার সদস্যরা, বন্ধ টিকেট বিক্রিও। সেখানে আরও দেখা যায়- মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার বতুনী গ্রামের মন্টু মিয়াকে। ফুলবাড়িয়ায় অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। তাকে ঢামেক হাসপাতালে আনেন বিয়াই মোসলেম। তারও ভর্তির ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এরপর তাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যায় স্বজনরা। এ ঢামেক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নাক-কান গলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ইউসুফ ফকির জানান, চিকিৎসকদের মারধরের ঘটনায় নিরাপত্তার কারণে সাময়িক চিকিৎসা বন্ধ করেছে ইন্টার্নরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরী বৈঠকে শেষে বিকেল ৫টায় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসাসেবা শুরু করেছে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ডাক্তার ও স্বজনদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওখান থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর বিকেল ৫টার দিকে জরুরী বিভাগ খুলে দেয়া হয়েছে। এখন রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান জানান, চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায়, ঘটনাস্থল থেকে রোগীর তিন স্বজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
×