ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানবাধিকার কমিশনের গোলটেবিল

জাতিসংঘকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

জাতিসংঘকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা গণহত্যা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিয়ানমার পুরো বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, মিয়ানমার শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার যে ধরনের টহল দেখিয়েছে বাংলাদেশ সেখানে অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। তাই বহুমুখী চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত এ সঙ্কট সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সম্মিলিত ও জোরালোভাবে পুরো বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি দেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে সকল ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তাদের সঙ্গে কোন ধরনের সামরিক চুক্তি করা যাবে না। জাতিসংঘকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে তা জাতিগত গণহত্যা। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ওই আইনে মিয়ানমারকে বিচারের সম্মুখীন করা যাবে তাও স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস : কল ফর এ্যাকশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে তিনি কথা বলেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত ওই বৈঠকে একাধিক সাবেক রাষ্ট্রদূত, মানবাধিকারকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থান যত বেশি দীর্ঘ হবে দেশের জন্য তা তত বেশি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে হুমকি সৃষ্টি করবে। মিয়ানমার আমাদের ওপর যে একটি বিষফোঁড়া সৃষ্টি করে দিয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অতিদ্রুতই তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে কারণে আমরা বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করি। চাপ প্রয়োগের কথা বলি। কারণ আমাদের প্রত্যাশাও বেশি থাকে। তিনি বলেন, কূটনীতি অবশ্যই ব্যতিক্রম। তবে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেসহ পুরো বিশ্বের মানুষও সচেতন রয়েছে। তাই এ ইস্যুতে দৃশ্যমাণ অগ্রগতি দেখাতে হবে। তিনি আরও বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতি প্রথমদিকে মন্থর থাকলেও পরবর্তীতে তা সচল হয়েছে। বর্ডার খুলে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন, জাতিসংঘে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে কোফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। যেহেতু মিয়ানমার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তাই তাদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক সংগঠন ও পুরো বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। কাজী রিয়াজুল হক বলেন, পরিকল্পিতভাবে তারা ২৮৮ গ্রাম পুড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী কোন গ্রামের কিন্তু কোন ক্ষতি হয়নি। মিয়ানমারের ঘটনায় গণহত্যার বহু উপাদান রয়েছে। জাতিসংঘকে স্পষ্টভাবে এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবেই আখ্যা দিতে হবে। কোন এথিনিক ক্লিনিং নয়, মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচার করতে হবে। তিন ঘণ্টারও দীর্ঘ সময়ের আলোচনায় উঠে আসে সঙ্কট সমাধানের বিভিন্ন দিক। হতাশার কথা জানালেও অধিকাংশই শুনিয়েছেন আশার বাণী। সঙ্কট সমাধানে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ওপর জোর দিয়েছেন সবাই। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে প্রচুর রোহিঙ্গা শিশু এ দেশে জন্মেছে এবং বহু নারী গর্ভবতী। এমন অবস্থায় প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে, যারা ভিন্ন মানসিকতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। একই ভাবে ১৩ হাজার শিশু যারা নিজের চোখের সামনে বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকে হত্যা হতে দেখেছে, তারাও ভিন্ন মানসিকতার মধ্যে রয়েছে। এসব ‘বিস্ফোরক’ বাচ্চারা যদি প্রতিহিংসাপরায়ও হয়ে ওঠে তাহলে মৌলবাদীদের লাগবে না, এমনিতেই উগ্রবাদের সৃষ্টি হবে। এখন তারা নিজেদের দেশে ফেরার জন্য আবেদন করছে, বছরকয়েক পর যদি স্বাধীন ভূখ- দাবি করে বসে, সেটি বিপজ্জনক হবে। সুতরাং এসব শিশুকে সঠিক পরিবেশে গড়ে তুলতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারাও বিভিন্ন সঙ্কটে আছে। ইতোমধ্যেই ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিরাপত্তার কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কোন কোন স্কুলে এখনও ক্যাম্প রয়েছে। বিভিন্ন স্কুলে থাকা ক্যাম্পগুলো দ্রুত সরিয়ে নেয়া হোক। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্দেহজনক মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। আমরা যাদের তথাকথিত হুজুর বলি, তারা কিন্তু সেখানে অর্থও বিতরণ করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী সেখানে তৎপরতা চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের হাত ধরে ইয়াবাও পাচার হচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্তক হতে হবে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আজিজুল হক বলেন, রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে আলোচনা করে কোন লাভ হবে না। সরকারকে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপানকে এ ইস্যুতে যুক্ত করতে হবে। কারণ মিয়ানামার তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সেই সঙ্গে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের যে বিকৃতি করছে, সেটিও রুখতে হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সংস্থা ইউএনএইচআরের প্রতিনিধি সিনজি কুবো বলেন, এ সঙ্কটের সমাধান হতেই হবে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, ইতোমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে গেছে। সেই সঙ্গে সেখানে মৌলবাদী গোষ্ঠীর লোকজনদের আনাগোনা চলছে। রোহিঙ্গারা যদি কোনভাবে তাদের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে সেটা আরও নতুন এক সমস্যার সৃষ্টি করবে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি সেখানকার বাসিন্দা ও আদিবাসীদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। মিয়ানমারে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে আসা মেজর জেনারেল (অব) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, রাখাইন রাজ্যে যারা ছিল কেবল তাদের নিয়ে সমস্যা। নাগরিকত্ব নিয়ে কেবল তাদের সমস্যা হচ্ছে। অন্য যায়গায়ও রোহিঙ্গা আছে। ওই দেশের ল-৪৮-এ বলা আছে প্রত্যেকেই কার্ড পাবে। দীর্ঘ সময় তারা আবেদন করেনি বলে জানা যায়। ওই দেশে ফিরে যাওয়ার পর তারা যদি নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন না করে তারা অধিকার পাবে না। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইউএনডিপির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর শায়লা খান বলেন, বালুখালী এখনও বসবাসের উপযোগী নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে বালুখালী নিয়েও কথা বলতে হবে। মিয়ানমার সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। এজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিশেষ ব্যক্তিদের আমরা অডিও-ভিডিও ভিজ্যুয়াল দেখিয়ে তাদের কাছে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শবনম আজিম বলেন, বিশ্বের কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে আমাদের অনেকগুলো ডকুমেন্টারি তৈরি করা উচিত, যেখানে দায়িত্বে থাকবে মানবাধিকার কমিশন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা অন্য সংগঠনগুলোকে ওই ডকুমেন্টারিগুলো পাঠাতে হবে। নজরে আনতে অনেকটা পাবলিক করে দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বীকৃত আইডি ও পেজ থাকতে পারে। সেখানে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ও ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবি আপলোড করা হবে। মডারেটের দায়িত্বে থাকবে মানবাধিকার কমিশন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) সাদিয়া ফয়জুন্নেসা বলেন, সাধারণ কূটনীতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোই প্রকৃত সমাধান। তবে সমাধান করতে গিয়ে কোনভাবেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না। হেসে হোক, কষ্টে হোকÑ আমরা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা চলছে। আসিয়ানভুক্ত দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কাজ করছি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হয়ত দ্রুত আরও একটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। ওআইসির সঙ্গে কাজ চলছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের কোন একটি দেশের পক্ষে ভেটো দেয়া হলে আলোচনাই হতো না। ২৮ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে কোন দেশ ভেটো দেয়নি। বরং মিয়ানমার সবার দ্বারে দ্বারে গেছে। নিরপত্তা পরিষদের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখছে। তিনি আরও বলেন, চীনকে আমরা বলেছি দুই বন্ধুকে তোমরা কিন্তু এক করে দেখতে পারো না। মানবতার শত্রু তোমাদের বন্ধু হতে পারে না। তাই কমন ফ্রেন্ডশিপের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। তারা বিষয়টি আমলে নিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুদের বার্মিজ ভাষাতেই লেখাপড়া করাতে হবে। অন্য ভাষাতে নয়। এতে আরও বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আলী সিকদার, স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান, অপরাজেয় বাংলাদেশ’র নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খালেদ মাহমুদ, দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হাবিবুর কবির চৌধুরী প্রমুখ।
×