ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চরম সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে রাবির চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

চরম সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে রাবির চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা

কায়কোবাদ খান, রাবি ॥ ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কি? (ক) পবিত্র কুরআন শরীফ (খ) পবিত্র বাইবেল (গ) পবিত্র ইঞ্জিল (ঘ) গীতা। মুসলমান রোহিঙ্গাদের উপর মায়েনমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে? (ক) ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ (খ) ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ (গ) ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ (ঘ) ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭।’ কোন ধর্মীয় পরীক্ষায় নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির চারুকলা অনুষদের সার্বজনীন প্রশ্নপত্রে এসেছে চরম সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষমূলক এসব প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত-বিএনপিপন্থী কতিপয় শিক্ষকের প্রণয়ন করা এই প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িকার বিষবাষ্প উগড়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে অসম্মান করা হয়েছে অন্য ধর্মাবলম্বীদের। এই ঘটনা জানাজানির পর থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সর্বত্র। খোদ চারুকলা অনুষদের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী বলছেন, যুগ যুগ ধরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করা চারুকলা অনুষদে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। জানা যায়, বুধবার দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রাবিতে চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষার সেট-২ এর ৭৬ নম্বর প্রশ্নে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নে তিনটি ধর্মগ্রন্থের সামনে ‘পবিত্র’ শব্দটি উল্লেখ করা হলেও হিন্দু ধর্মের গ্রন্থ গীতার আগে ‘পবিত্র’ শব্দটি লেখা হয়নি। সব ধর্মের ভর্তিচ্ছুরা পরীক্ষায় অংশ নেয়ায় এই প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষার হলেই আপত্তি তোলে পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। আবার ৪১ নম্বর প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, ‘মুসলমান রোহিঙ্গাদের উপর মায়েনমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে?’ এই প্রশ্নের মাধ্যমেও সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট ধর্ম উল্লেখ করে মানুষ পরিচয়টিকেই অস্বীকার করার অভিযোগ উঠেছে। চারুকলা অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেহেদী হাসান রাসেল বলেন, নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতির সবাই মানুষ, তাদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে হাইলাইট করে হামলাকারী হিসেবে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দাঁড় করানো হয়েছে। এটা সাম্প্রদায়িকতা। মিয়ানমার যদি এই ভুল করেও থাকে, আমরা কেন এরকমটা শেখাবো যে মুসলিম আর বৌদ্ধ শত্রু? চারুকলা অনুষদের পাঁচ অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষক ও চারুকলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান চারুকলার অধিকাংশ শিক্ষককে বাদ দিয়ে কতিপয় জামায়াত ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। এমনকি প্রগতিশীল শিক্ষক হওয়ায় প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটিতে অনুষদের তিন বিভাগের মধ্যে অন্য দুই বিভাগের সভাপতিকেও রাখা হয়নি। আরেকটি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই। অনুষদের কয়েকজন শিক্ষক নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, এবারের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে অনেক ভুল আছে। দক্ষ শিক্ষকদের বাদ দিয়ে ডীন তার পছন্দের লোকদের নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করায় এমনটা হয়েছে। আগের বছরের প্রশ্ন প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে নিলে এই সংকটের সৃষ্টি হতো না। এ ব্যাপারে মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোস্তফা শরীফ আনোয়ার বলেন, এটা কোন প্রশ্ন হতে পারে না। আমরা দুই বিভাগের সভাপতি ডীনকে প্রশ্ন বাতিল করতে বলেছি। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয় এজন্য এই দুই প্রশ্নে সবার উত্তরকেই সঠিক হিসেবে গণ্য করা হবে। পরবর্তীতে আমরা দেখবো কীভাবে এটা হলো। প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ও ডীনদের নিয়ে মূল কমিটি থাকে। তারা প্রশ্ন আহ্বান করেন এবং পরে প্রশ্নগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এ ধরনের প্রশ্ন কিভাবে ঢুকলো এবং কারা জড়িত পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। পরবর্তীতে চেয়ারম্যানদের নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটিতে দুই বিভাগের সভাপতিকে না রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্ন প্রণয়ন অত্যন্ত গোপন প্রক্রিয়া। অনুষদের ডীনই সিদ্ধন্ত নেন এই কমিটিতে কারা থাকবে। গোপনীয়তা রক্ষার্থে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন রাখাটা ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে প্রশ্নকর্তারা ইমম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরণের প্রশ্ন প্রণয়ন করে বিতর্ক সৃষ্টি করা না হয় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে। এদিকে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের বিচার দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও রাবি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। মানববন্ধনে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী রাবি শাখার সভাপতি প্রদীপ মার্ডী বলেন, চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাম্প্রদায়িক চিন্তা সংযোজন করেছে। যেটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের জন্য অপমানজনক। মানববন্ধনে বক্তারা প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
×