ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিন গোমেজ

অভিমত ॥ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

অভিমত ॥ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে

রোহিঙ্গা সমস্যার শেকড়ে কেউই যেন হাত দিতে চায় না। সকলে কেবল যেন এর কয়েকটি ক্ষতস্থানের একটি স্থানেই পানি ঢালার বিষয়ে কথা বলছেন। ব্রিটিশরা একটি মস্তবড় ভুল করে মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা তৈরি করে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গা নামটি বাদ পড়ে যায়। যার ফলে বার্মার ইতিহাস থেকে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকারের একটি সুযোগ তৈরি হয়। যা তাদের দীর্ঘ অবস্থানকে ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে দেয়। জাপানী যুদ্ধের আগ্রাসনের মুখে পরে ব্রিটিশরা পিছু হটতে থাকে। দুই দেশের যুদ্ধের মাঝামাঝি পড়ে প্রাণ হারাতে থাকে অসহায় রোহিঙ্গারা। যুদ্ধবিধ্বস্ত আরাকান ছেড়ে ২২ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় চট্টগ্রামে। এগুলো তাদের ভুল নয়। ভুলটা শুরু হয় এখান থেকে। ১৯৪৭ সালে একটি বড় ভুল করে রোহিঙ্গারা। দ্বিজাতিতত্ত্বের হাওয়া রোহিঙ্গাদের মনেও দুলতে থাকে। আরাকানে তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা বৌদ্ধদের সঙ্গে থাকবে না ঘোষণা দেয় এবং গোপনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করে। মংদু ও বুথিধাং এলাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়। জিন্নাহ সেই প্রস্তাবে আগ্রহী হননি, প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু রোহিঙ্গারা সেখানেই থেমে যায়নি। তারা আরাকানে ‘মুসলিম পার্টি’ গঠন করে জিহাদী আন্দোলন শুরু করে একটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। এই যুদ্ধ বার্মা সরকারের বিরুদ্ধে, যা ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত স্থির ছিল। এই জিহাদীদের দমন করতে ১৯৭৮ সালে ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ পরিচালিত হয়। যার ফলে প্রায় ২ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ এবং বহু পাকিস্তানের করাচীতে চলে যায়। নিজ দেশের বিরুদ্ধে এমন বিদ্রোহ তাদের সম্মান বাড়ায়নি, বরং তাদের আস্থাহীন করে তুলেছিল। রোহিঙ্গাদের সেই সময়ের অবস্থানকে মিয়ানমারের জনগণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে। যার দরুন অন্য মুসলিমরা নাগরিকত্ব পেলেও রোহিঙ্গারা এর মধ্যে স্থান পায়নি। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচির এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশা করা গিয়েছিল যে, সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে তার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। কোফি আনান কমিশনের রিপোর্টও তারা আমলে নিচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে আমাদের দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসছে। নিবন্ধিত রোহিঙ্গার তুলনায় বহুগুণ বেশি রয়েছে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। বেসরকারী হিসেবে এটি তিন থেকে চার লাখ। এমনিতেই বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ। সেখানে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয়দান নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে। এক শ্রেণির রোহিঙ্গা চোরাচালান, অবৈধ অভিবাসন ও মানবপাচারে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাদেরই কোন কোন দল নৌকায় করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। রোহিঙ্গাদের কারণে আশ্রয়দাতা দেশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আর কতকাল বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভার বহন করবে? মিয়ানমার সরকারই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ অভিমুখে ঠেলে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের। আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এ আচরণ অবশ্যই নিন্দনীয়। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে জাতিগত ও রাজনৈতিক কারণে নিপীড়নের শিকার মুসলিম রোহিঙ্গারা দুই দশক আগে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আহ্বান জানিয়ে এলেও মিয়ানমারের দিক থেকে সাড়া মেলেনি। কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপাড়ার বর্তমানে রোহিঙ্গাদের দুটি শরণার্থী শিবির রয়েছে। এতে নিবন্ধিত ৩৪ হাজার শরণার্থী থাকলেও এর বাইরে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজার জেলার মোট জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২৫ শতাংশই অবৈধ এবং তারা মিয়ানমারের নাগরিক। এ ছাড়া বান্দরবানেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা আছে। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের সীমান্ত ফাঁড়িতে হামলার পর সামরিক অভিযানে রাখাইনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক দমন-নিপীড়ন চালানো হয়। সে সময় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে এই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৯ লাখের বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার দুটি দিক আছে। একটি মানবিক, অপরটি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। রোহিঙ্গারা যে নিজ দেশে জাতিগত নিপীড়নের শিকার, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তাদের মানবিক আশ্রয় দিয়েছে, বিতাড়িত করেনি। কিন্তু শরণার্থীদের কারণে যদি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে থাকে, কিংবা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মনে করি, সময় এসেছে জাতিসংঘের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের। মিয়ানমার সরকারের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সৌদি আরবসহ বিশ্বের ধনী মুসলিম দেশগুলো দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এরপরও শরণার্থীদের আগমনের বিষয়টিকে মোকাবেলা করতে হবে। আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় আচরণ করেছে। কিন্তু আমাদের নিজেদেরই সম্পদ সীমিত। সরকার যে ব্যাপক সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের পুশ ব্যাক করছে না, একে আমরা স্বাগত জানাই। কোন একটি সমস্যার কারণে যখন মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, প্রতিবেশী কোন দেশে আশ্রয় নেয়, তখন গোটা বিশ্বের দায় পড়ে ওই মানুষগুলোকে আগে বাঁচানো। পাশাপাশি গোটা বিশ্বেরই দায় পড়ে, কেন ওই মানুষগুলো বাস্তভিটা ছেড়ে, শত শত বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা এবং সমাধান করা। এ ধরনের সমস্যা মেটানো সম্পূর্ণরূপে বিশ্ব ফোরামের এবং বিশ্বের সকল দেশের দায় অবশ্যই। লেখক : শিক্ষার্থী [email protected]
×