ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবারের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ভেন্যু না পাওয়ায় বাতিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৭

এবারের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব ভেন্যু না পাওয়ায় বাতিল

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে নির্মল আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। শিল্পীর সংখ্যা ও সময়ের বিবেচনায় বিশ্বের বৃহত্তম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরটি প্রশান্তির পরশ ছড়িয়েছিল কংক্রিটের শহর ঢাকায়। বিগত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠতম আসরে এসে থমকে গেল লাখো শ্রোতা-দর্শককে আলোড়িত করা উৎসবটি। ভেন্যু হিসেবে আর্মি স্টেডিয়াম বরাদ্দ দেয়নি সেনা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড। তাই ভেন্যু না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত উৎসব বাতিল ঘোষণা করল আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। আগামী ২৩ থেকে ২৭ নবেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসব হওয়ার কথা ছিল। সেই সুবাদে ভারতের প্রখ্যাত শিল্পীসহ দেশের নবীন-প্রবীণ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীদের উৎসবে অংশগ্রহণসহ সার্বিক আয়োজনের সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেন্যু না পাওয়ায় ২০১৭ সালের উৎসব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আর্মি স্টেডিয়াম বরাদ্দ না পাওয়ার বিষয়টিকে অজানা কারণ হিসেবে উল্লেখ করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। রবিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এবারের উৎসব বাতিলের ঘোষণা দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল আবুল খায়ের লিটু। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। এবার উৎসব না হওয়ার কথা উল্লেখ করে বেদনাহত কণ্ঠে আবুল খায়ের বলেন, এ বছর এক অজানা কারণে উৎসবের ভেন্যু আর্মি স্টেডিয়াম বরাদ্দ দেয়া হয়নি। হয়তো জায়গা দিতে না পারারও কোন কারণ আছে। তবে কারণটি আমরা জানি না। তাই সব আয়োজন চূড়ান্ত করেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবটি বাতিল করতে বাধ্য হলাম আমরা। বড় পরিসরে এ উৎসব আয়োজনের জন্য নিরাপত্তা, যাতায়াত সুবিধা এবং মানুষ জমায়েতের জন্য উপযুক্ত জায়গার বিষয়টি সময়মতো মীমাংসা না হওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক দেশী-বিদেশী শিল্পী ও কলাকুশলীকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন খবর পেয়ে বহু শিল্পী আশাহত হয়েছেন। বিদেশী শিল্পীরা বাংলাদেশের শ্রোতা-দর্শকের সামনে উপস্থিত হতে না পারায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আবুল খায়ের আরও বলেন, আর্মি স্টেডিয়ামের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেনা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের পক্ষ থেকে অন্য কোন জায়গায় উৎসবটি আয়োজন করতে বলা হয়েছিল। শিল্পী ও শ্রোতা-দর্শকের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অন্য ভেন্যুতে উৎসব আয়োজনে রাজি হইনি আমরা। তাই এবারের উৎসবটি বাতিল করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। গত পাঁচ বছর এই ভেন্যুটি ব্যবহার করতে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। উৎসব আয়োজনে নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে সরকার। ব্যক্তিগতভাবে এই উৎসবকে সার্থক করার জন্য সহায়তা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এবার উৎসব যেহেতু হচ্ছে না তাই সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ থাকবে, এটি যেন হারিয়ে না যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ থাকবে তিনি যেন পরবর্তীতে এই উৎসব অব্যাহত রাখার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রয়োজনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এ উৎসবের আয়োজন করা হোক। সেখানে কোন সহযোগিতার দরকার হলে সেটা দিতেও আমরা প্রস্তুত। কারণ, এই উৎসবের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষকে সংযুক্ত করা। এ আয়োজনের মাধ্যমে আপামর মানুষের মানবিকতা ও মনন তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তাই এটি ঘরোয়া কনসার্টের পরিবর্তে হয়ে উঠেছিল জনগণের উৎসব। তিনি আরও বলেন, আর এটিকে শুধু উৎসব নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়েছিলাম। এদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি শ্রোতা তৈরির বিষয়টিকে মুখ্য হিসেবে নিয়েছিলাম। সে অর্থে ২০১২ সালের উৎসবের প্রথম আসরে শ্রোতা তৈরি ছিল না। পরবর্তী আসরগুলোয় প্রমাণ হয়েছে, ভাল কিছু হলে দেশের মানুষ সেটা গ্রহণ করে। টানা পাঁচ দিন সারারাত ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উপভোগ করেছে লাখো শ্রোতা-দর্শক। উৎসবের ভেন্যু হিসেবে আর্মি স্টেডিয়াম কেন বরাদ্দ পাওয়া গেল না এমন প্রশ্নের জবাবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ভেন্যু বরাদ্দ না দেয়ার জন্য হয়তো কোন কারণ আছে। তবে ভেন্যু বরাদ্দ না পাওয়ার প্রকৃত কারণটি আমাদের অজানা। উৎসব আয়োজনের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। অন্য একটি ভেন্যুতে এ উৎসব আয়োজনের জন্য আমাদের বলা হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক মানের উৎসব সব জায়গায় করা যায় না। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের বিশ্বখ্যাত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন এ উৎসবে। এমন বৃহৎ আয়োজনের গ্রন্থনা, শিল্পীদের সময়সূচী ঠিক করাসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা সারতেই আট মাস সময় লাগে। নিবিড়ভাবে সব বিষয় সমন্বয়ের পর পরিকল্পনা পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। আর আমরা কোন অগোছালো আয়োজন করতে চাই না, তাই এবারের উৎসব আয়োজন থেকে সরে এসেছি। এবার উৎসবটি না হওয়ায় বিদেশী শিল্পীরাও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শ্রোতা-দর্শকের বিপুল অংশগ্রহণের কারণে তাদের কাছেও এই উৎসবটি পেয়েছে মর্যাদা। এ উৎসবে অংশ নিতে বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পীরা। তাছাড়া দেশের মানুষ যেভাবে এ উৎসবকে যেন হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে, সেটাও অনেক বড় প্রাপ্তি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছর ধরে নির্ধারিত ভাড়া জমা দিয়ে আর্মি স্টেডিয়াম বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। এ বছরও ভেন্যুটি পাওয়ার জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মার্চ মাসের ৫ তারিখে ভেন্যুটি পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয় আর্মি স্টেডিয়ামের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেনা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের কাছে। উৎসবের জন্য ২০ থেকে ২৮ নবেম্বর পর্যন্ত ভেন্যু চাওয়া হয়। পরবর্তীতে ৩১ আগস্ট এক চিঠির মাধ্যমে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ জানায়, নবেম্বরে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের কারণে ভেন্যু দেয়া সম্ভব না। কারণ, তাকে নিয়ে আর্মি স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, পোপের আগমনের তারিখ ৩০ নবেম্বর অর্থাৎ উৎসব শেষ হওয়ার দু’দিন পর এবং তাকে নিয়ে প্রধান আয়োজনটি আর্মি স্টেডিয়ামে হবে না। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর বেঙ্গলের পক্ষ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ভেন্যু বরাদ্দ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হলেও পরবর্তীতে সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোন জবাব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বাতিল ২০১৭ সালের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবারের উৎসবের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এবারই প্রথমবারের মতো উপমহাদেশের বাইরে থেকে যুক্ত করা হয় ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল। ড. এল সুব্রহ্মণ্যম রচিত ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল কম্পোজিশন পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় ৫৬ সদস্যের অর্কেস্ট্রা দলকে। এর পাশাপাশি উৎসবে যোগ দেয়ার কথা ছিল মেওয়াতি ঘরানার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী প-িত যশরাজের। মোহনবাঁশী পরিবেশনের জন্য প-িত বিশ্বমোহন ভট্ট, ঘাটম ও মৃদঙ্গম বাদনের জন্য বিদ্যান ভিক্কু বিনায়ক রামকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়া প্রথমবারের মতো আসার কথা ছিল বেহালা শিল্পী ড. মঞ্জুনাথ মাইসুর, নৃত্যশিল্পী অদিতি মঙ্গলদাস, সংগীতশিল্পী পন্ডিত কৈবল্য কুমার, সেতারশিল্পী প-িত বুধাদিত্য মুখার্জির। প্রথম থেকে এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, প-িত উল্লাস কশলকার, ওস্তাদ শাহেদ পারভেজ খান, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, ওস্তাদ রশিদ খান, কৌশিকী চক্রবর্তীর এবারের আসরে অংশ নেয়ার কথা ছিল। সংবাদ সম্মেলনে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের পরিবেশনা উপস্থাপন করে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই সঙ্গীতালয়ের কনিষ্ঠ ছাত্রী ইলহাম ফুলঝুরি খান জৌনপুরী রাগে তার গুরু পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের রচনা বাজিয়ে শোনান সরোদে।
×