ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে জীবন ধারণের সুযোগ-সুবিধায় ঢল থামছে না

অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ধরে রেখে মুখ রক্ষার চেষ্টা মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৩ অক্টোবর ২০১৭

অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ধরে রেখে মুখ রক্ষার চেষ্টা মিয়ানমারের

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ সহিংসতার মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও বর্তমানে যারা রয়েছে দেশান্তর চায় না মিয়ানমার সরকার। বরং বহির্বিশ্বে মুখ রক্ষার জন্য হলেও বাকিদের রাখার প্রয়োজন মনে করছে তারা। কিন্তু ধরে বেঁধেও রাখাইনে আটকে রাখা যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের। সেখানে অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কার পাশাপাশি বাংলাদেশে ত্রাণসহ নানা সুব্যবস্থা তাদের প্রতি সীমান্ত অতিক্রমের হাতছানি হিসেবে কাজ করছে। রাখাইনে এখন কোন ধরনের সেনা অভিযান কিংবা দমন-পীড়ন নেই। তারপরও অনুপ্রবেশ থেমে নেই। রাখাইন রাজ্যে দায়িত্ব পালনরত একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে মাসখানেক সময়জুড়ে রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে সহিংসতা থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন শক্তিধর দেশগুলোর চাপের মুখে। বর্তমানে সে নির্যাতন একেবারেই নেই। বরং বিদেশী বিভিন্ন সংস্থাকে দেখানো এবং দেশের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে মিয়ানমার সরকার এখন কিছু রোহিঙ্গা বসতি থাকার প্রয়োজন অনুভব করছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এতটাই বাংলাদেশমুখী যে, তাদের আর আটকে রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের বাহিনী রোহিঙ্গাদের পলায়নপথে বাধা দেয়ারও চেষ্টা করছে। তারপরও স্বজন, প্রতিবেশী এবং পরিচিতদের একটি বিরাট অংশ কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় চলে আসায় বাকিরাও সেখানে থাকতে চাইছে না। তাছাড়া এখান থেকে খবর যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নানা কল্যাণকর পদক্ষেপ ও কর্মসূচীর। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে এদেশে যে জায়গা নির্ধারণ এবং আবাসনের পরিকল্পনা চলছে তা তারা অবগত হচ্ছে ওপারে থেকেও। এখানে পাওয়া যাচ্ছে খাদ্য, চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের যাবতীয় উপকরণ ও সেবা। অপরদিকে মিয়ানমারে জীবন ধারণের জন্য করতে হবে পরিশ্রম। সব মিলিয়ে মানবিক বাংলাদেশ এখন টানছে রোহিঙ্গাদের। রাখাইনের মংডুতে দায়িত্বরত জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনডিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, সেখানে এখন নির্যাতনের কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। গত কোরবানির সময় ঈদ জামাতের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংও করা হয়েছে। তাছাড়া যারা রয়েছে তাদের নিরাপত্তার আশ্বাসও প্রদান করা হচ্ছে। মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচিও জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে জানিয়েছিলেন, রাখাইনে অভিযান শেষ। তারপরও রোহিঙ্গারা কেন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তা তিনি খতিয়ে দেখবেন। শুরুতে সুচির ভাষণ বেশ সমালোচিত হলেও এখন যে রাখাইনে সেই নির্যাতন ও তা-ব নেই তা অনেকেই মানছেন। বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে তারাও এখন আর আগের মতো নির্যাতনের কথা বলছে না। তবে জানাচ্ছে যে, সেখানে খাদ্যের বড়ই অভাব। দিনে একবেলা খাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জানতে পেরেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করছে। ভাসানচরে পুনর্বাসনে আপত্তি স্থানীয়দের ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের চিন্তা ভাবনা চলছে হাতিয়া দ্বীপ সংলগ্ন ভাসানচরে। বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা এই দ্বীপ উন্নয়নে কাজ করছে নৌবাহিনী। জনবসতির জন্য দ্বীপটি এখনও শতভাগ উপযোগী নয়। তবে উন্নয়নের মাধ্যমে একে বাসযোগ্য করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানবিক আচরণকে সমর্থন জানালেও রোহিঙ্গাদের সেখানে পুনর্বাসনে আপত্তি হাতিয়া এবং সন্দ্বীপ উপজেলার অধিবাসীদের। জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনাগ্রহী রোহিঙ্গারা ॥ মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় রাখাইনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনিয়ন্ত্রিত প্রজননকে। কোন কোন পরিবারে ১৬টি পর্যন্ত সন্তান রয়েছে। পরিবারপ্রতি গড় সন্তান সংখ্যা ৫ থেকে ৬ জন। বাংলাদেশে যে রোহিঙ্গারা এসেছে তার মধ্যেও অন্তত ৬০ ভাগ শিশু। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, চিকিৎসাসহ নানামুখী ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্যও কাছ করছে সরকারের সংস্থাগুলো। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ না করার কৌশল ॥ সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে যারা বাংলাদেশে এসেছে তাদের গ্রহণ না করার কৌশল আগেই পাকাপোক্ত করে রেখেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তাদের ভাষায় রোহিঙ্গারা বাঙালী সন্ত্রাসী। তাদের হাতে যে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) ধরিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে ‘বাংলাদেশী অভিবাসী’ পরিচিতি। কার্ডের ৭ নম্বর পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের ভাষা ‘বাংলা’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এমন পরিচয় দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। রোহিঙ্গারা আরাকানের আদিবাসিন্দা হয়েও কেন বাংলাদেশী বলে মিথ্যা তথ্যের বোঝা বহন করবে? এজন্য রোহিঙ্গা নেতা এবং বয়োবৃদ্ধদের পরামর্শে রোহিঙ্গারা সে কার্ড গ্রহণে অপারগতা জানায়। তখন থেকেই তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, তারা বার্মিজ আদিবাসী এবং জাতিসত্তায় ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’। ১৭৯৯-১৮১৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চাকরির সময় জরিপ করেছিলেন ফ্রান্সিস বুকানন। সে জরিপের প্রতিবেদনেও রাখাইন অঞ্চলের ‘রুয়িঙ্গা’ ভাষাভাষী মানুষের বর্ণনা পাওয়া যায়। তারা মনে করছে, এখানেই রয়েছে বর্বর বার্মিজদের কূটকৌশল। এ জাতিগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করতে চায় না মিয়ানমার। কারণ রোহিঙ্গা স্বীকার করলেই আরাকানের ভূমিপুত্র প্রমাণ হতে পারে সেই আশঙ্কা থেকে যায়। রোহিঙ্গাদের অভিবাসী বাঙালী মুসলমান বলে আসছে তারা। আরও এক রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার ॥ টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মিঠাপানির ছড়া সৈকতে ভেসে আসা আরও একটি রোহিঙ্গা নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় মিঠাপানির ছড়া এলাকায় ভেসে আসে এ অর্ধগলিত লাশটি। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার যাচ্ছেন ॥ বাসস জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য আজ সোমবার ওই দেশটি সফরে যাচ্ছেন। তিনি রবিবার তার মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে বলেন, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যাও এজেন্ডায় থাকবে। সফরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আট সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। প্রতিনিধিদলে থাকবেন- পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), অতিরিক্তি সচিব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল দেশটি সফরে যাচ্ছে। প্রতিনিধিদলটি ২৫ অক্টোবর দেশে ফিরবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আলোচনার মাধ্যমে সকল অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে চাই এবং আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটিও স্থান পাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অনেক বছর আগে মিয়ানমারের ৫ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছিল এবং সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আরও ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। রোহিঙ্গা শিবির দেখতে আজ আসছেন জর্দানের রানী ॥ কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আজ সোমবার বাংলাদেশে আসছেন জর্দানের রানী রানিয়া আল আবদুল্লাহ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) এ তথ্য জানিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৮২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারী হিসাবে এ সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। এখনও থামেনি রোহিঙ্গা স্রোত। পালিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ মানুষের মানবিক সহায়তা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে ক্ষুধা আর রোগের শঙ্কা বিরাজ করছে ভয়াবহভাবে। রোহিঙ্গাদের এই বিপন্নতা দেখতেই রানী রানিয়া বাংলাদেশে আসছেন। রানিয়া আল আবদুল্লাহ আইআরসির একজন বোর্ড সদস্য। একই সঙ্গে তিনি জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থার একজন পরামর্শক। তার সফর সংক্রান্ত বিবৃতি থেকে জানা গেছে, একটি বিশেষ ফ্লাইটে জর্দানের রানী চট্টগ্রামে যাবেন। সেখান থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাবেন। সেখানে স্বচক্ষে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখবেন। কথা বলবেন ওই শরণার্থীদের সঙ্গে। শুনবেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী। সফর শেষে সংবাদমাধ্যমকে নিজের অভিজ্ঞতা জানাবেন রানিয়া। তবে ঢাকায় জর্দানের রানীর কোন কর্মসূচী নেই।
×