ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ২৩ অক্টোবর ২০১৭

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে? ভাবছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বাস্তবতা হচ্ছে তারা কেউ নন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি হচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ওয়াশিংটন পোস্টের ভাষায় এক শতাব্দীর মধ্যে এত শক্তিধর নেতার আগমন চীনের ইতিহাসে সম্ভবত আর হয়নি। চীনের অর্থনীতি আকার-আয়তন এখনও যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় স্থানে। চীনের সামরিক বাহিনীর দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি পেলেও আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ম্রিয়মাণ দেখাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক সম্ভারই সবকিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট তার সাম্প্রতিক পূর্বসূরিদের তুলনায় স্বদেশে দুর্বল ও বিদেশে কম কার্যকর। অন্যদিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কর্তৃত্ববাদী দেশটির প্রেসিডেন্ট বিদেশের মাটিতে সদর্পে পদচারণা করেন। মাওয়ের পর অন্য যে কোন নেতার তুলনায় চীনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ অনেক শক্ত। মাওয়ের চীন যেখানে ছিল বিশৃঙ্খলাময় ও গরিব সেখানে শি জিনপিং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা পালন করছেন। শি তার অসংখ্য বিদেশ সফরে নিজেকে শান্তি ও মৈত্রীর দূত হিসেবে তুলে ধরে থাকেন। এই বিশৃঙ্খল ও গোলযোগপূর্ণ বিশ্বে তিনি যেন এক যুক্তিবাদীর কণ্ঠস্বর। গত জানুয়ারিতে ডাভোসে শি বিশ্ব এলিটদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্বায়ন, মুক্তবাণিজ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি দৃঢ়ভাবে মেনে চলবেন। শিয়ের বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। তার আংশিক কারণ বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রার সর্ববৃহৎ মজুদ তাদের হাতে। তার ‘এক অঞ্চল এক পথ’ (বেল্ট এ্যান্ড রোড) হেঁয়ালিপূর্ণ শোনালেও এর বক্তব্য পরিষ্কার। চীনের শত শত বিলিয়ন ডলার বিদেশে রেলপথ, বন্দর, বিদ্যুতকেন্দ্র ও অন্যান্য অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করা হবে এবং তাতে করে বিশ্বের এক বিশাল অঞ্চলে সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোর মার্শাল প্ল্যানের পর থেকে এ ধরনের নেতৃত্ব আমেরিকাও দেখাতে পারেনি। আর মার্শাল প্ল্যানও ‘বেল্ট এ্যান্ড রোডের’ তুলনায় ছিল যথেষ্টই ছোট। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনের নজিরবিহীন সামরিক শক্তিও বিদেশের কাছে তুলে ধরছেন। এ বছর তিনি জিবুতিতে চীনের প্রথম বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটির উদ্বোধন করেন। চীনের নৌবাহিনীকে তিনি আরও দূরে মহড়ায় পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে একটি ছিল গত জুলাইয়ে বাল্টিক সাগরে ন্যাটোর দোরগোড়ায় রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ মহড়া। চীনের বক্তব্য হচ্ছে ‘নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার জন্য সে কখনই অন্য দেশে হামলা চালাবে না। তার ঘাঁটি নির্মাণের উৎস্যগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি রক্ষা, জলদস্যু দমন ও মানবিক মিশনে সহায়তা করা। তবে দক্ষিণ চীন সাগরে তারা কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেখানে সামরিক মানের যেসব রানওয়ে বানাচ্ছে তা নিতান্ত আত্মরক্ষামূলক বলে দাবি করে চীন। চীন বিশ্বের কোথাও গোলযোগ সৃষ্টিতে কোন্ ধরনের ভূমিকা রাখছে এমন অভিযোগ তার শত্রুরাও করে না। তবে দেশটির কিছু সামরিক আচরণে তার প্রতিবেশীরা উদ্বিগ্ন। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, ভারত ও জাপানও উদ্বিগ্ন। স্বদেশে শি জিনপিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতোই অনুদার ও কঠোর। তিনি মনে করেন সামান্য রাজনৈতিক অধিকারটুকু দিলেও তার পরিণতি হতে পারে সর্বনাশা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিণাম তাকে তাড়া করে ফেরে। নিরাপত্তাবোধের এই অভাব থেকে তিনি শুদ্ধি অভিযানে সরিয়ে দেয়া তার শত্রুদেরই যে শুধু অবিশ্বাস করেন তাই নয়, দ্রুত বর্ধিষ্ণু মধ্যশ্রেণী এবং এর উপজাত নাগরিক সমাজকেও অবিশ্বাস করেন। রাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলে এবং অর্থনীতিকে দৃঢ়ভাবে পার্টির পরিচালনাধীনে রেখে তিনি চীনা সমাজকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর। শি জিনপিংয়ের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আরও বেড়েছে। কিন্তু অন্যান্য বিশ্ব নেতার কাছ থেকে অভিযোগের গুঞ্জন আদৌ শোনা গেছে কিনা সন্দেহ। কিছু আশাবাদীর বক্তব্য হলো বিশ্ববাসী এখনও আসল শি জিনপিংকে দেখেনি। এবারের কংগ্রেস তাকে তার ক্ষমতা সুসংহত করতে সাহায্য করবে। এরপর তিনি সর্বান্তকরণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করবেন। ইতোমধ্যে দুর্নীতি খর্ব করতে তিনি অপেক্ষাকৃত সফল হয়েছেন। সেই সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি সংস্কারে হাত দেবেন। সেই ২০১২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে শি চীনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন চীনা নীতির পুনরুজ্জীবনের কথা বলেছিলেন। ‘চাইনিজ ড্রিম’ নামের একটি লোকগীতি অচিরেই সমস্ত মিউজিক চার্টের শীর্ষে স্থান পায়। সেই স্বপ্নের কথামালা উৎকীর্ণ লাল পোস্টারে গোটা দেশ ছেয়ে যায়। এবারের পলিট ব্যুরো বৈঠকেও শি বলেছেন, পার্টির দায়িত্ব হচ্ছে চীনা নীতির পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নকে অনুসরণ করা। তার এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার কোথায় তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সেই অগ্রাধিকার অর্থনীতির ওপর নয়, বরং কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা এবং বিশ্বে চীনের অবস্থানের ওপর। শি জিনপিংকে মাও সেতুং ও দেং জিয়াও পিংয়ের পর চীনের তৃতীয় নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যিনি দেশকে রূপান্তর এনে দিচ্ছেন। মাও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেং দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করেছিলেন। আর শির লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় মঞ্চে যথাযোগ্য আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেইসঙ্গে আবার কমিউনিস্ট পার্টিকে রক্ষা করা। শির ব্যক্তিগত ক্ষমতার পরিধি কতদূর ব্যাপ্ত তা তার ধারণকৃত পদগুলো দেখলেই বোঝা যাবে। তিনি একাধারে প্রেসিডেন্ট, কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান এবং সুপ্রীম কমান্ডার। এই শেষের পদবিটি গত জুলাই মাস থেকে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে আসে, যা সর্বশেষ দেং জিয়াও পিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আমলাতন্ত্রের ওপর নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রায় সকল পার্টি নেতাকে, চীনের ৩১টি প্রদেশের গবর্নরকে এবং পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) প্রায় সকল শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে সেসব জায়গায় নিজের পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছেন। এবারের পার্টি কংগ্রেসে দলের গঠনতন্ত্রে তার নামে কমিউনিজম সংক্রান্ত রচনাবলীর উল্লেখ করে তার এক ধরনের আদর্শিক প্রাধান্যের পথ রচনা করা হচ্ছে। সেই ২০১২ সালে তার নিজের এবং যারা তাকে চীনের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল সেই এলিট শ্রেণীর মনে হয়েছিল যে, কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। দলের সদস্যদের, এমনকি সিনিয়র ক্যাডারদের মধ্যেও অনেকে আছে যাদের কমিউনিজমের ওপর বিশ্বাস প্রবল নয় এবং যারা পার্টির প্রতি অনুগত নয়। তাই শুরু হয় পার্টির অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান। সেই অভিযান অনেকাংশেই সফল হয়েছে বলে তারা আজ মনে করছেন। এভাবে পার্টির ওপর শি জিনপিংয়ের পূর্ণ কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের ভূমিকা সম্প্রসারিত করে পিএলএর ওপর পার্টির কর্তৃত্ব বাড়িয়ে তুলেছেন। এভাবে ১৪০ কোটি মানুষের চীনা জাতির ওপর কর্র্তৃত্ব করার ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এটা কোন স্বাভাবিক অবস্থা নয়, বরং বিপজ্জনক। কারোর হাতেই এত বেশি ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। এক ব্যক্তির শাসন শেষ পর্যন্ত দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং বিদেশে একতরফা বা খামখেয়ালি আচরণের পথ রচনা করে। শি জিনপিংয়ের এই একচ্ছত্র ক্ষমতার উত্থান সেদিকেই নিয়ে যাবে কিনা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×