ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেশবপুর হাসপাতালে চিকিৎসার বেহাল দশায় মানুষ ছুটছে ক্লিনিকে

প্রকাশিত: ০২:২৩, ২২ অক্টোবর ২০১৭

কেশবপুর হাসপাতালে চিকিৎসার বেহাল দশায় মানুষ ছুটছে ক্লিনিকে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেশবপুর ॥ কেশবপুরের প্রায় তিন লাখ মানুষের চিকিৎসার সেবার একমাত্র হাসপাতালে চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের অবহেলা, উদাসীনতা ও অর্থ বাণিজ্যের কারণে কেশবপুরের মানুষ ঠিকমতো স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে মানুষ স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। বিশেষ করে দীর্ঘকাল হাসপাতালে ডাক্তারের অভাবে যাবতীয় অপারেশন বন্ধ থাকায় রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে। অপারেশন বা সাধারন চিকিৎসার রোগিদের হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে অনেক ডাক্তার অপারেশন ও পরীক্ষা নিরীক্ষার অজুহাতে শহরে তাদের নিজস্ব চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছেন। পয়সা পান না বলে ডাক্তাররা মূলত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন অপারেশন করেন না বলে রোগীর স্বজনদের অভিযোগ। আর সকল বিষয়ে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন বর্তমান হাসপাতাল কর্মকর্তা। তিনি জানিয়েছেন হাসপাতালের অনেক ডাক্তার কর্মচারী তাঁর কথা শোনেনা। কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। দুই হাজার সালে ৩১ শর্য্যা বিশিষ্ট হাসপতালটি ৫০ শর্য্যায় উন্নীত করা হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্বক্ষণিক লোকবলের অভাব থাকায় এখানকার মানুষ বরাবরই স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। প্রতিদিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তাররা বর্হিবিভাগে দেড়’শ থেকে দুই’শ রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। মাঝে মাঝে বিষপান এবং সড়ক দূর্ঘটনার রোগি ভর্তি হন। জ্বরায়ু, সিজার, ডিম্বাশয়ের টিউমার, নাড়ী ছিদ্র, নাড়ী জড়ানো, হার্নিয়া, এপেন্ডিস, অন্ডকোষের পানি, পিত্তথলিতে পাথর এবং প্রস্রাবের থলির নানা জটিলতা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। অপারেশনের সকল যন্ত্রপাতি থাকলেও এ জাতীয় কোন অপারেশন ডাক্তারের অভাবে করা হয় না। মাঝে মধ্যে দু’এক জনকে অপারেশন করা হলেও তারা হলেন যারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করেন তাদের আত্মীয় স্বজন। চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র ৯ জন গর্ভবর্তী মাকে সিজার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই জন সিজার রোগির মৃত্যু হয়েছে। মাইনর অপারেশন হয়েছে ২৫৪টি। এ সময়ের মধ্যে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার ৬১৫ জন রোগীকে। পাশাপাশি শহরের ৭টি ক্লিনিকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৮৬৩ জন রোগীকে সিজার ও মাইনর অপারেশন করা হয়েছে এবং ৮০ হাজার ১৬৩ জন রোগীকে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। শহরের মহাকবি মাইকেল ক্লিনিক, কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল ক্লিনিক, মডার্ণ ক্লিনিক, মাতৃমঙ্গল ক্লিনিক, কেশবপুর সার্জিক্যাল ক্লিনিক, হেলথ কেয়ার হসপিটাল ও নাগরিক হসপিটাল ঔষধ ও সার্জন ফিসহ জ্বরায়ু অপারেশন ৪ থেকে ৬ হাজার, সিজার অপারেশন সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার, স্বাভাবিক সন্তান প্রসব দেড় থেকে ২ হাজার, ডিম্বাশয়ের টিউমার অপারেশন ২ থেকে ৩ হাজার, নাড়ী ছিদ্র অপারেশন ৫ থেকে ৮ হাজার, নাড়ী জড়ানো অপারেশন ৫ থেকে ৮ হাজার, হার্নিয়া অপারেশন ২ থেকে ৩ হাজার, এপেন্ডিস অপারেশন ৯‘শ থেকে ১২‘শ, অন্ডকোষের পানি অপারেশন ২ থেকে ৩ হাজার, পিত্তথলির পাথরসহ অন্যান্য অপারেশন ৫ থেকে ৭ হাজার এবং প্রস্রাবের থলির নানা জটিলতা অপারেশন করে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। এ ৭টি ক্লিনিকে রোগী অপারেশন করা হয় কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার এবং যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে সার্জন এনে। যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার কোন ক্লিনিকে এ জাতীয় অপারেশন করানো হলে ঔষধ ও সার্জন ফি বাদে রোগীকে ৪/৫ গুন বেশি টাকা দিতে হয়। কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে কোন ধরণের অপারেশন না হওয়ায় রোগীদেরকে যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় নিয়ে অপারেশন করালে টাকা লাগে কয়েকগুন বেশি। তাই বাধ্য হয়ে মানুষ কেশবপুরস্থ ক্লিনিকমূখী হয়ে পড়েছেন। তারপরও ক্লিনিকে ডাক্তার, নার্স না থাকায় রোগী মৃত্যুর হার দিনদিন বেড়েছে। কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ৮ জন ডাক্তার ও ১৯ জন নার্স কর্মরত। অপারেশনের সকল যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও কোন রোগীকে অপারেশন করা হয় না। স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সের কর্মরত ডাক্তারদের অবহেলা, উদাসীনতা ও অর্থ বাণিজ্যের ব্যাপারে উপরি মহলও নিশ্চুপ থাকায় এলাকাবাসি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্যবর্তী স্থান হওয়ায় কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সের গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমে কলারোয়া, দক্ষিণে ডুমুরিয়া ও তালা, উত্তরে মনিরামপুর উপজেলার অবস্থান সন্নিকটে হওয়ায় এ ৪টি উপজেলার অধিকাংশ দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসা ও অপারেশনের জন্য কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। কিন্তু এখানে ভাল চিকিৎসা সেবা ও অপারেশন না হওয়ায় তারা কম খরচে শহরের ৭ টি ক্লিনিকে চিকিৎসা ও অপারেশন করিয়ে থাকেন। উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের আব্দুল গণি গাজীর স্ত্রী শিউলী বেগম, ভান্ডারখোলা গ্রামের মৃত পীর আলীর মেয়ে সাজেদা খাতুন, মধ্যকুল গ্রামের সুশান্ত সরকারের স্ত্রী পূর্ণিমা সরকার জানান, তাদের প্রসাব বেদনা শুরু হলে গত ১৫ অক্টোবর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে ক্সে আনা হয়। কোন ডাক্তার তাদেরকে সিজারিয়ান অপারেশন করতে রাজি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাদের শহরের মর্ডাণ ও কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল ক্লিনিকে নিয়ে সিজারিয়ান করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর ভালুকঘর গ্রামের মাহাবুবুর রহমানের স্ত্রী পারভীনা খাতুন ও ফতেপুর গ্রামের মফিদুল ইসলামের স্ত্রী ফতেমা খাতুন এরা দুজনই অন্তসত্ত্বা। হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হন। এছাড়া বাউশলা গ্রামের জোহর সরদারের ছেলে জসিম উদ্দিন এলার্জি জনিত রোগের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সের ডাক্তার বোরহান উদ্দিন চৌধুরীর কাছে গেলে তিনি কমিশন বাণিজ্যের আশায় তার রক্তের পরীক্ষা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে না করে মনোয়ারা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠান। অপরদিকে ঔষধ বিক্রয় প্রতিনিধি এবং ঔষধের দোকানগুলি থেকে অবাক হবার মত তথ্য পাওয়া গেছে। ৭১টি ঔষধ কোম্পানীর প্রতি মাসে কেশবপুর শহরের ঔষধের দোকানগুলিতে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা থাকে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং তা পুরন হয় প্রতিমাসে। বিক্রয় প্রতিনিধিদের তথ্যে আরও জানা যায় অনেক মাসে চাহিদা মাফিক ঔষধ তারা সরবরাহ করতে পারেন না। মহাকবি মাইকেল ক্লিনিকের মালিক ও ক্লিনিক মালিক সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দীন গাজী জানান, কেশবপুরের ক্লিনিকগুলোতে কম খরচে যে সব অপারেশন করা হয় তা অন্য কোথায়ও সম্ভব হবে না। যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে সার্জন এনে ক্লিনিকগুলোতে রোগী অপারেশন করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘদিন কেশবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপরেশন বন্ধ রয়েছে এবং জটিল কোন রোগী স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে গেলে তাকে না দেখেই রেফার্ড করে দেওয়া হয় অন্যত্র। এছাড়াও কোন রোগীর চিকিৎসা নিতে গেলে তাকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের কোন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সে বাবদে ডাক্তার প্রতি রোগীর জন্য পেয়ে থাকেন ২শ টাকা এবং কমিশন তো আছেই। তিনি আরও বলেন, শহরের ৭টি ক্লিনিকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৮৬৩ জন রোগীকে সিজার ও বিভিন্ন রোগের অপারেশন করা হয়েছে এবং ৮০ হাজার ১৬৩ জন রোগীকে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শেখ আবু শাহীন জানান, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কনসালটেন্ডসহ ৩২ জন ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও ইউনিয়নসহ আছে ১২ জন। জনবল সংকট এবং সার্জন না থাকায় অপারেশন করা হয় না। তিনি এক পর্যায়ে শিকার করেন অনেক ডাক্তার ও কর্মচারি ক্ষমতাশালী হওয়ায় তারা কোন নির্দেশ মানে না। কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মিজানূর রহমান জানান, চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন বন্ধ রয়েছে। তবে কিছু দিনের মধ্যে ৩ জন চিকিৎসক যোগদান করবেন। তখন হয়ত অপারেশন করা হবে।
×