ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ট্রেলিয়ার মরুতে ১৮ শতকের বাংলা পুঁথির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২২ অক্টোবর ২০১৭

অস্ট্রেলিয়ার মরুতে ১৮ শতকের বাংলা পুঁথির সন্ধান

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ অস্ট্রেলিয়ার একটি দুর্গম অঞ্চলের প্রায় পাঁচ শ’ কিলোমিটার গভীর মরুভূমিতে বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল একটি প্রাচীন গ্রন্থ। যাকে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরান মনে করে সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। কিন্তু একজন অস্ট্রেলিয়ান -বাংলাদেশী গবেষক সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন এটি আসলে বাংলা ভাষায় লেখা শত বছরেরও আগের একটি পুঁথি। খবর বিবিসি অনলাইনের গবেষক ড. সামিয়া খাতুন এই গবেষণার সূত্র ধরে বিশ শতকের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় তৎকালীন বাংলা এবং ভারতবর্ষ থেকে মানুষের অভিবাসনের চমকপ্রদ এক ইতিহাসের সন্ধান পেয়েছেন যা নিয়ে তার একটি বই শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে লন্ডন থেকে। ড. সামিয়া খাতুন বলেন, ইতিহাসের বইতে যখন তিনি ওই কোরান পাওয়ার কথা পড়েন তখন তিনি তা দেখতে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ শ’ কিলোমিটার দূরে গিয়ে বইটি খুঁজে বের করার পর খুলে দেখি সেটি কোরান নয়, বাংলা কবিতা। ড. খাতুন তার গবেষণায় দেখেছেন, বহু বাঙালী জাহাজে চেপে সে সময় ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। উটের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিল বহু বাঙালী। অনেক বাঙালী সে সময় আয়ার কাজ করতে সেখানে যান বলে তার গবেষণায় উঠে এসেছে। তিনি বলছেন, এরা সে সময় অস্ট্রেলিয়ার দূরবর্তী দুর্গম মরু অঞ্চলে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ড. খাতুনের মতে, এই পুঁথিটি প্রথমে ছাপা হয়েছিল ১৮৬১ সালে। পরে এটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়। যে কপিটি তার হাতে আসে সেটি ১৮৯৫ সালের ছাপা। সামিয়া খাতুন বলেন, এসব মানুষের কাজ ও বসতির সূত্র ধরে অস্ট্রেলিয়ার ব্রোকেনহিল শহরে তাদের প্রথম অভিবাসী হয়ে আসার আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য পাওয়া গেছে। তার মতে, এদের অনেকে উট নিয়ে কাজ করতে করতে সেখানে গিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি লোক জাহাজে কাজ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছিলেন, এরপর যে কোন একটা কাজ জুটিয়ে মরুভূমি এলাকায় বা অস্ট্রেলিয়ার গহীন অঞ্চলে পৌঁছে যান। এই গবেষক বলেন, সেখানে যে মসজিদগুলো ছিল এই লোকেরা সেই মসজিদগুলোতে ঈদের সময় জড়ো হতেন। এভাবেই ব্রোকেনহিলসহ আশপাশের দুর্গম এলাকাগুলোয় তখন বাঙালীদের একটা বসতি গড়ে ওঠে । আঠারো এবং উনিশ শতকে বিশ্বজুড়ে একটা ব্যাপক অভিবাসনের ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোক সে সময় নানা জায়গায় গিয়ে বসতি গড়েন। ড. খাতুন আরও বলছেন, ওই একই সময়ে অস্ট্রেলিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এই বাঙালি অভিবাসীরা তখন অস্ট্রেলিয়ায় গহীন এলাকায় পুঁথিপাঠ করতেন। এই বইয়ে যে বাংলা কবিতাগুলো রয়েছে সেগুলো গান আকারে অন্যদের পড়ে শোনানো হত- যেমনটা প্রাচীনকালে বাংলায় পুঁথিপাঠের ধারা ছিল। তিনি বলছেন, এ থেকে বোঝা যায় ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে বাঙালীদের মধ্যে পুঁথিপাঠের একটা সংস্কৃতি চালু ছিল। গবেষণায় ড. খাতুন দেখেছেন সেখানে ওই সময় একটা বড়সড় বাঙালী জনগোষ্ঠী ছিল বলেই এই পুঁথিপাঠের চর্চা গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়া অন্য দেশ থেকে সেখানে যাওয়া অনেক মানুষ সেই পুঁথিপাঠ শুনতে আসতেন যারা বাঙালী ছিলেন না। তাদের জন্য অনুবাদ করে এইসব কবিতা শোনানো হতো। ড. খাতুন বলছেন, সে ইসময় যেসব বাঙালী ওই দুর্গম অঞ্চলে বসতি করেছিলেন তাদের বংশধররা এখনও আছেন। সে সময় স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে এরকম অনেক বাঙালীর বিয়ে হয়। তারা অবশ্যই তখন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালী ছিলেন। ফলে তাদের বংশধরদের এখন পাওয়া যায় আদিবাসী এ্যাবোরোজিন সম্প্রদায়ের মধ্যে যেহেতু ওই বাঙালীদের মধ্যে অনেক মিশ্র বিষয়ের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। এই গবেষক আরও বলেন, সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই মিশ্র বিষয়ের কারণে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ্যাবোরোজিন সম্প্রদায়ের ভাষায় ঢুকে গেছে বহু বাংলা শব্দ। যেমন চাপাটি শব্দকে ওরা বলে জাপাটি, ট্যাঙ্ক হয়ে গেছে টাঙ্কি- এরকম বহু শব্দ রয়েছে। তারপর উট নিয়ে যেহেতু তারা কাজ করতেন, তাই উটকে ওখানকের লোকেরা এখনও উটই বলে থাকে। তিনি বলছেন, সে সময় যে মসজিদগুলো সেখানে ছিল, সেগুলোর কয়েকটা ধ্বংস হয়ে গেলেও কয়েকটা এখনও টিকে আছে এবং ওই মরু এলাকা খুবই শুষ্ক হওয়ার কারণে যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর ভেতরে সবকিছু এখনও খুব ভালভাবেই রয়েছে।
×