ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা দিয়ে ১৪ জনের মুক্তি

চাকরির লোভ দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায়

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২২ অক্টোবর ২০১৭

চাকরির লোভ দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায়

ফিরোজ মান্না ॥ ভাল বেতন ও উন্নত দেশে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে দেশ থেকে কয়েক শ’ তরুণকে লিবিয়ায় নেয়া হয়েছে। এই তরুণদের দেশটিতে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে যাচ্ছে একটি চক্র। ওই চক্রের হাতে সম্প্রতি ২২ বাংলাদেশী নাগরিককে জিম্মি করা হয়। জিম্মি করার পর চক্রটি পরিবারের লোকজনদের টেলিফোন করে নানা ভয়ভীতির কথা বলে লাখ লাখ টাকা দাবি করে। এই দাবি মিটাতে পারলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে তাদের জিম্মিই থেকে যেতে হচ্ছে। সম্প্রতি এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ১৪ জন মুক্তি পেলেও ৮ জনের মুক্তি এখনও মেলেনি। ভুক্তভোগীদের মুক্তিতে সহযোগিতা করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতারকচক্রের হাত থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে দেশে আসার পর ভুক্তভোগীরা জিম্মি দশার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। পিবিআই জানিয়েছে, প্রতারক চক্রের কার্যক্রম মাফিয়াচক্রকেও হার মানিয়েছে। তারা ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েই দানবের মতো আচরণ শুরু করে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নানাভাবে নির্যাতন চালায়।নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে দেশে অভিভাবকের কাছে টেলিফোন করে টাকা চায়। টাকা না দিলে তাদের মেরে ফেলবে। এমন কথা শোনার পর অভিভাবকরা যে কোন উপায়ে টাকা পাঠিয়ে দেয় দালাল চক্রের কাছে। দালাল চক্রের সঙ্গে দেশী ও লিবিয়ার লোক যুক্ত রয়েছে। দেশীয় দালাল চক্রের সন্ধানে নেমেছে পিবিআই। তদন্তের স্বার্থে পিবিআই দেশে ফিরে আসা নাগরিকদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে অপারগতা জানায়। তারা ইতোমধ্যে কয়েকজন দালালের নামও পেয়েছে। তাদের ধরার জন্য চেষ্টা চলছে। জিম্মি থাকা বাকি আটজনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে পিবিআই। তাদের উদ্ধার ও জিম্মি করেছে যারা তাদের আইনের আওতায় আনতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেছে পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভুক্তভোগীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রতারকচক্রের দেশীয় চার সদস্যকে আটক করেছে বলে পিবিআই’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপে পাড়ি দেয়ার জন্য শুধু যে লিবিয়ার রুট ব্যবহার করা হচ্ছে তা নয়। পাচারকারীরা ইরাককে মানব পাচারের নতুন রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ থেকে তরুণরা লিবিয়া ও ইরাক হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সাগর পথে ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে। বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দালাল মিলে একটি বড় চক্রের হাত ধরে তারা জীবনবাজি রাখছেন। গত ৬ মাসে লিবিয়াতে তিন শয়ের বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে পাচার করা হয়েছে ইউরোপে নেয়ার জন্য। লিবিয়ার পথ কিছুটা কঠিন হওয়ায় এখন তারা ইরাকের পথে মানব পাচার করছে। দু’টি রুট দিয়ে সাগর পথে এসব তরুণদের পাচার করতে গিয়ে অনেকে সাগর সমাধি বরণ করেছেন। আবার অনেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হয়েছেন। ভাল চাকরি তাদের ভাগ্যে জোটেনি। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ইউরোপে যাওয়া বন্ধ হয়নি। বরং দালাল চক্র নতুন নতুন রুট খুঁজে বের করছে। বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে ইউরোপগামী তরুণদের মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে দেশী-বিদেশী দালাল গোষ্ঠী। তারা হয় সাগরে ডুবে মরছে না হয় স্থান পাচ্ছেন কারাগারে। সূত্র জানিয়েছে, ইরাকের ভিসা সহজ হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে তাদের ইরাকে নিয়ে আসছে। ইরাক থেকে সাগর পথে তাদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ তরুণই ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপ যেতে পারেননি। তাদের অনেককে সাগরে ডুবে মরতে হয়েছে, না হয় তারা বিভিন্ন দেশের কারাগারে স্থান পেয়েছেন। ভাল চাকরি তাদের কপালে জোটেনি। দালাল চক্র ইরাকে প্রবেশ করার কয়েক দিনের মধ্যে সাগর পথে ইউরোপের সুবিধাজনক দেশে পাঠায়। ইউরোপে পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনেক দালাল বিমান ভাড়া নিয়ে বাকিতে ইরাক থেকে ইউরোপে পাঠাচ্ছে। ইরাক থেকে দালালরা প্রথমে বাংলাদেশীদের তুরস্কে ঢোকানোর চেষ্টা করে। এ যাত্রায় সফল হলে ইউরোপে ঢোকাতে দালালদের কম কষ্ট করতে হয়। তবে তুরস্কে ঢোকাতে না পারলে সিরিয়ার অরক্ষিত বর্ডার দিয়ে সাগরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে ইউরোপের যে কোন দেশে ঢোকিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশীরা জানান, এয়ার এরাবিয়ার মতো এয়ারলাইন্স দিয়ে মানব পাচারের মতো অপকর্ম বেশি চলে। এই এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে শারজাহ থেকে কাতার যায় বাংলাদেশী তরুণরা। এরপর কাতার থেকে ইরাকে পাড়ি জমায়। এছাড়া ফ্লাই দুবাই নামে আরেকটি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশীরা ইরাকে আসছে। এ দুই এয়ারলাইন্স দিয়ে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে বেশি। জানা গেছে, ইউরোপে পাড়ি জমানোর পর টাকা দিতে হবে এমন শর্তে নিরীহ যুবকদের ফাঁদে ফেলছে দালাল চক্র। ইউরোপে বসবাসরত বেশির ভাগ বাংলাদেশী অভিবাসী তুরস্ক, সিরিয়া বা লিবিয়া হয়ে এসেছেন। এখন নতুন করে ইরাক হয়ে গ্রিস, ইতালি বা ইউরোপের অন্য দেশে আসছেন। নৌকায় করে ইউরোপে পাড়ি জমানো অনেক কষ্টকর। দিনের পর দিন নৌকায় কাটাতে হয়। মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে। দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে ইউরোপে আসার পর নানা ঝামেলায় পড়েন বাংলাদেশীরা। প্রথম সমস্যা ভাষা জানেন না তারা। ফলে ইচ্ছা থাকলেও কয়েক মাস কাজ পান না। নৌকায় করে ইউরোপে আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশী অশিক্ষিত হওয়ায় ভাষা শিখতে তাদের অনেক সময় লাগে। নৌকায় করে আসা বাংলাদেশীদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। তারা জানে না তাদের ভাগ্যে কি রয়েছে।
×