ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীঘ্রই বিএনপির সহায়ক সরকারের রূপরেখা

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২২ অক্টোবর ২০১৭

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে নির্বাচন

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শীঘ্রই সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে বিএনপি। আর এ রূপরেখা চূড়ান্ত করতে যত দ্রুত সম্ভব দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকবেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যেই ২০ দলীয় জোটের ি শরিক দলের কাছে সহায়ক সরকারের রূপরেখার জন্য প্রস্তাব আহ্বান করেছে বিএনপি। তাদের দেয়া প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপির প্রস্তাবের সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করা হবে। জানা যায়, বিএনপি এমনভাবে নির্বাচনের সময় সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করছে যাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে নির্বাচন করার কথা বলা হবে। এ বিষয়ে বিএনপির একাধিক বিকল্প প্রস্তাব থাকবে। তবে ঘুরেফিরে একই কথা থাকবে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা প্রয়োগের বাইরে রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনে যেন প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করেন এবং এ কমিশন যেন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। এদিকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণার পর এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতারও চেষ্টা করবে বিএনপি। সমঝোতা না হলে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নেবে দলটি। তবে এখনও নানামুখী সঙ্কট থাকায় আন্দোলন সফল করার বিষয়ে দলের ভেতরেই সংশয় রয়েছে বলে জানা গেছে। তাই বিএনপি চাচ্ছে দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মহলকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনকালে দলের জন্য সুবিধা আদায় করে নিতে। আর এর জন্যই আলোচনার সুযোগ তৈরি ও জনগণের দৃষ্টি দলের পক্ষে নিতে জাঁকজমকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে বিএনপি। জানা যায়, বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা ও দলীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ক’জন বুদ্ধিজীবীর চেষ্টায় সহায়ক সরকারের একটি খসড়া রূপরেখা আরও আগেই তৈরি করে রেখেছে বিএনপি। ৩ মাস লন্ডনে অবস্থানকালে এ বিষয়ে ছেলে তারেক রহমানের মতামতও নিয়েছেন খালেদা জিয়া। শীঘ্রই দলের সর্বোচ্চ ফেরামে স্থায়ী কমিটির ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তা তুলে ধরবেন। সেই সঙ্গে এই রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে এ নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানাবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার কাছেও এই রপরেখা পাঠানো হবে। সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফর শুরু করবেন। এ সময় তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সহায়ক সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে এ বিষয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করবেন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলা নেতাদের খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সফর সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে। এক বছর ধরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। ১৫ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার সময় দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল শীঘ্রই তিনি দেশে ফিরে সহায়ক সরকারের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি ৩ মাসেরও বেশি সময় খালেদা জিয়া লন্ডনে অবস্থান করার কারণে এখনও তা ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করে চরম বেকায়দায় পড়ে দলটি। এর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২দিনের সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেশ ক’বার ক্ষমতায় থাকা এ রাজনৈতিক দলটি। জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি কিছু নতুন কৌশল অবলম্বন করবে। ৩ মাস লন্ডনে অবস্থানকালে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে এ কৌশল নিয়ে খালেদা জিয়ার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত ২০০১ সালের নির্বাচনকালে তারেক রহমানের কৌশল প্রয়োগ করেই বিএনপি সফল হয়। তবে এবার দেশের বাইরে অবস্থান করে তারেক রহমান বিএনপিকে কতটা সহায়তা করতে পারবে এ নিয়ে খোদ বিএনপিতেই নানামুখী কথা হচ্ছে। সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিএনপিকে বাধ্য হয়েই এ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। আর এ কারণেই দলটি চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হলে আর প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে হয়ত সে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর বিজয়ী হতে না পারলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবে। আর এ লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করছে বলে জানা গেছে। বিএনপির নির্বাচন সময়ের সরকারের রূপরেখার খসড়ায় যা রয়েছে বলে জানা গেছে তার মধ্যে ওই সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো তিন মাস। নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে সক্রিয় না থাকেন সে বিষয়টি বিএনপির রূপরেখায় প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এ জন্য দলের ভেতর কয়েক ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব হচ্ছে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ না করার শর্তে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিন মাসের এই সহায়ক সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। আর আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অধীন মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল বিশেষ করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া। এর মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকারের আদলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা। এ ছাড়া নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে সহায়ক সরকারের প্রধানের বিষয়ে প্রস্তাব করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নির্দলীয় ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব। যার ১০ ভাগ টেকনোক্র্যাট কোটায় যেমন স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাতে পারবেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। আরও বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় না থাকে এবং তিনি যেন নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, শীঘ্রই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে সহায়ক সরকারের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী যেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকা-ে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন সে ব্যবস্থা না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাই বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখায় এ বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। এ ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কি ধরনের সরকার থাকবে এবং এ জন্য আর কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়েও প্রস্তাব করা হবে। আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে।
×