ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়েঘুম, ভুনা খিচুড়ি বাইরে দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২২ অক্টোবর ২০১৭

ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়েঘুম, ভুনা খিচুড়ি বাইরে দুর্ভোগ

মোরসালিন মিজান বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? বৃষ্টি যা হওয়ার, বর্ষায় হয়েছে। এর আগে এবং পরেও কম কাঁদেনি আকাশ। আর এখন তো হেমন্ত। নতুন ঋতুকে পায়ের ওপর ভর দিয়ে একটু দাঁড়াতে তো দাও। দেখি, তার কী দেখানোর আছে! কিন্তু কে শুনে কার কথা। ষড় ঋতুর চরিত্রের বারোটা বাজাতে ওঠে পড়ে লেগেছে বৃষ্টি। হেমন্তে হানা দিয়েছে। শীত নামাতে একটু আধটু বৃষ্টির দরকার হয় বৈকি! তাই বলে এত? কাজের কাজী যারা, যাদের শুক্র বা শনিবার বলে কিছু নেই, রেগে মেগে অস্থির তারা। অনেকের বাইরে বেড়ানো ভেস্তে গেছে। ছিঁচকাদুনে আকাশের নিন্দে করছেন তারা। বকছেন খুব। তবে অপেক্ষাকৃত ‘অলস’ ‘আরামপ্রিয়’ আর ‘ফাঁকিবাজ’ বাঙালীর মুখে মুচকি হাসি। তাদের আনন্দ আর ধরে না! হেমন্তের বৃষ্টির সঙ্গে ঝিরিঝিরি হাওয়া। শীত শীত ভাব। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে আছে? বুদ্ধিমানরা কাঁথার নিচে ঢুকে গেছেন। দিনে দুপুরে লম্বা ঘুম। আর ঘুম ভাঙতেই রসনাবিলাস। ভুনা খিচুড়ি সাজানো ছিল খাবার টেবিলে। পরিবারের সবাই চেটেপুটে খেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তো বৃষ্টির প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেছিল খিচুড়ি! কার বাসায় কোন রেসিপি জানতে মোটেও সময় লাগেনি। সুন্দর করে সাজিয়ে ছবি তুলে তার আপডেট ফেসবুকে দিয়েছেন গৃহিণীরা। বৃষ্টির প্রথম দিন শুক্রবার সন্ধ্যার পর পর মগবাজারের একটি সুপার শপে গিয়ে খোঁজ নিতেই জানা গেল, সব আছে। নেই শুধু গরুর মাংস। কেন? জানতে চাইলে বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, বৃষ্টি তো, ঘরে ঘরে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। গরুর মাংস তাই অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাংস না পাওয়া গেলেও খিচুড়ি খাওয়া থেমে থাকেনি। কয়েকজন ব্যাচেলরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ডিম দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছেন। কারও কারও বাসায় আবার মাংস ছিল। খিচুড়ির চাল ছিল না। তাই ভাতের চালে খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছেন তারা। সবই হয়েছে মনের আনন্দে। বৃষ্টির দিনে ঝালমুড়িরও বিপুল চাহিদা। এই দলে যারা তারা কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ কুঁচি আর খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে নিয়েছেন মুড়ি চানাচুর। তাতেই জমজমাট ‘মুভি টাইম।’ ইউটিউবে পছন্দের সিনেমা খুঁজে নিয়ে দেখেছেন। বৃষ্টি নিয়ে কোন কবি কী লিখেছিলেন গুগলে ইঞ্জিনের সাহায্যে তা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন তরুণ তরুণীরা। রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি নিয়ে যত গান, শুনেছেন। বর্ষা পর্যায়ের হলেও, এই হেমন্তের সঙ্গে গানগুলোর কোন বিরোধ চোখে পড়েনি। বৃষ্টির সঙ্গে হাসিরাশি আনন্দের যোগ থাকলেও, বেদনার সুরটিই বেশি বাজে। হয়ত তাই কানে এসেছে কবিগুরুর চির চেনা সুর ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...।’ নজরুল থেকেও কম গুনগুন হয়নি। এফএম রেডিওতে কান পাততেই শোনা গেলÑ ‘বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...।’ কাগজের নৌকো বানানোর শৈশবও ফিরে এসেছিল। বাসার বড়রা সাদা কাগজ ভাঁজ করে নৌকো বানিয়ে ছোটদের দিয়েছিলেন। সেই নৌকো বৃষ্টির জলে দিব্যি ভেসেছে। এভাবে ঘরের ভেতরে দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠেছিল বৃষ্টি। এদিকে বাইরে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। টানা বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় রাজধানীবাসীকে। সাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার রাত থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, শুক্রবার দিনে এসেও থামেনি। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকায় ৭৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। রাতেও অব্যাহত ছিল বর্ষণ। শনিবারের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। এদিন সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগই দেয়নি বৃষ্টি। এরপরও যাদের বের হতে হয়েছে তারা শিকার হয়েছেন চরম দুর্ভোগের। শহরের অধিকাংশ প্রধান সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। দুপুরের পরে বৃষ্টি কিছু সময়ের জন্য কমেছিল। তখন ফার্মগেট কাওরান বাজার শাহবাগ পল্টন সেগুনবাগিচা কাকরাইল এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। রাস্তায় নেমে দেখা যায়, গাড়ি বলতে কিছু নেই। দীর্ঘ সময় পরে এক একটি পাবলিক বাস আসছিল। জলের বুক চিরে এগিয়ে চলা বাসগুলোকে মনে হচ্ছিল ইঞ্চিন চালিত ট্রলার! সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বিকল হয়ে পড়েছিল এখানে ওখানে। রমনা পার্কের লেকের দিকে তাকিয়ে চোখ ছানাভরা! জল উপচে পড়ছিল। রমনার বটমূল ছুঁয়ে দিয়েছিল লেকের পানি। একই কারণে শনিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও ক্লাস হয়নি। জানা যায়, সকালে স্কুল কলেজ থেকে ফোন করে ক্লাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ক্লাস করার মতো ছাত্রছাত্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এসএম হলের সামনের জায়গাটিকে নদী বৈ অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না। এই হলের শিক্ষার্থী তৌহিদুর রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বন্যায় ডুবে গেছে এসএম হল, সকাল থেকে তাই কিচ্ছু খাওয়া হয়নি, দুপুরের খাবারও রিস্কে আছে। কেউ ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসলে খুব ভাল হতো....।’ জবাবে আমিনুল ইসলাম নামের এক বন্ধু তাকে লিখেছেন, ‘পুরো ঢাকাতেই একই অবস্থা। মানুষ ত্রাণ নিয়ে বেরুবে কী করে!’ এ অবস্থায় আজ রবিবার থেকে খুলবে অফিস আদালত। সাপ্তাহিক বন্ধ শেষে কাজে ফিরবেন সবাই। কিন্তু বৃষ্টি নিয়ে অনেকেই আছেন শঙ্কায়। আরও হবে বৃষ্টি? কতদিন এভাবে চলবে? জবাবে আশার বাণী শুনিয়েছে আবহাওয়া অফিস। কর্মকর্তাদের মতে, আজ রবিবার থেকে বৃষ্টি কমে আসবে। আর তাহলে বাইরের দুর্ভোগ কমবে। ঘরে যে আরাম, কমবে সেটিও!
×