ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাসার তাসাউফ

শামসুর রাহমানের কবিতায় জীবনের গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ অক্টোবর ২০১৭

শামসুর রাহমানের কবিতায় জীবনের গল্প

‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।/সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে /আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না/যখন শরীরে বসন্তের সম্ভার আসেনি/যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো/বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান/লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়...!’ শামসুর রাহমানের এ কবিতাটি পড়েছিলাম আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির নিঝুম বারান্দায় বসে অন্ধকার কোন রাতে কেরোসিন তেল দিয়ে জ¦লা কুপির আলোয়। তখন আমার বয়স কত ছিল তার কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, তখন আমি স্কুল পড়ুয়া কিশোর। তখনও আমাদের গ্রামে ইলেট্রিসিটি আসেনি। তার মধ্যে বাড়িটা ছিল বৃক্ষের ছায়াঘেরা নির্জন ভৌতিক এক আবাসভূমি। সন্ধ্যেবেলায় সূর্যটা ডুবে গেলে শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো গ্রাম হয়ে যেত নিঝুম অন্ধকার আর রাত গভীর হলে প্রকৃতিতে নেমে আসত রহস্যময়তা। অরণ্য আঁধারে প্রেতিনীর কান্না, শেওড়া গাছের ভূত অথবা অশরীরী আত্মার আনাগোনা ছিল রূপকথার মতো। আমার মা ঘরের দরজায় খিল এঁটে ভৌতিক কিচ্ছা-কাহিনী বলতেন। আমি ভয়ে কুঁকিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। প্রাইমারির গ-ি পেরিয়ে যখন মাধ্যমিকে উঠলামÑ একদিন বিকেলে বাবা বাজারের লাইব্রেরি থেকে কিছু গল্প-কবিতার বই নিয়ে এলেন। বইগুলো ছিল কিশোরদের পড়ার উপযোগী, দুয়েকটা বড়দেরও ছিল। ভূতের ভয় কাটাবার জন্য ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ নামের আমি হাতে নিয়ে কয়েক পাতা ওল্টে ‘কখনো আমার মাকে’ শিরোনামের কবিতাটি পড়ে ফেললাম এক নিশ^াসে। পড়ার পরই আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। কয়েকবার পড়া হলে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক ‘দোল’-এর অনুভূতি তৈরি হয়েছিল এবং সেটি মনের গহীনে দোলায়মান ছিল বহুক্ষণ, এমনকি বহুদিনও। কবিতাটি পড়তে পড়তে প্রায় প্রতিটি শব্দে, বাক্যে আমি আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম অথবা কবির মা-ই হয়ে উঠেছিল আমার মা। মনে হয়েছিল, আরে ঠিকই তো! আমিও তো কখনও আমার মাকে কোনদিন গান গাইতে শুনিনি! কবি যেন আমার কথা, আমার মায়ের কথাই বলেছেন। ‘মনে পড়ে, যখন ছিলাম ছোট, ঈদে/ সদ্যকেনা জামা-জুতা প’রে/ সালাম করার পর আম্মার প্রসন্ন হাত থেকে/ স্বপ্নের ফলের মতো একটি আধুলি কিংবা সিকি/ঝরে যেত ঝল্মলে ঝনৎকারে আমার উন্মুখ আনন্দিত হাতে...।’ ‘দশ টাকার নোট এবং শৈশব’ নামের এ কবিতাটির মতো আরও অজস্র কবিতা, গল্পে মানুষের কথা বলে যাওয়া এক কবির নাম শামসুর রাহমান, যিনি স্বদেশের ভাবনাতাড়িত হয়ে কাব্য রচনায় ছন্দময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে ধারণ করেছেন বাঙালী ও বাংলা ভাষার অনন্য কবির পরিচয়। আপন কাব্যশৈলীর গুণে আবির্ভূত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কাব্যভুবনের সবচেয়ে আলোচিত কবি হিসেবে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ কবির জন্ম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মায়ের নাম আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ১৯৪৫ সালে পুরনো ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এমএ (প্রিলমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তবে শেষ পর্বের পরীক্ষা দেননি। জীবনের একটা বড় অংশজুড়ে শামসুর রাহমান নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবির কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ভূমিকা ছিল সনাতনের মধ্যেও স্বতন্ত্র। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে কাব্য রচনা করেছেন অবলীলায়। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে কবিতা ও গানে। ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর এ দুটি কবিতা পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ‘১৯৪৯’ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। শুরুতেই ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতা সৃষ্টির অপার সম্ভাবনার ইঙ্গিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রগ’ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রগাঢ় নিমগ্নতা, অন্তর্গতবোধ ও ভাবনাজগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থে। শামসুর রাহমান ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ইংরেজী ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন পর তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। কিন্তু অনুষ্ঠান প্রযোজকের কাজটি তিনি উপভোগ করতে পারেননি। মাত্র চার বছর (১৯৬০-১৯৬৪) রেডিওতে কাজ করার পর আবার ফিরে আসেন ‘মর্নিং নিউজ’-এ। সেখানে তিনি উচ্চতর পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের নবেম্বর থেকে ১৯৭৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ‘দৈনিক বাংলা’ ও ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অধুনা’র সম্পাদকের দায়িত্ব¡ পালন করেন। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কবিগণ যুক্ত হয়ে গঠিত করলেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। উক্ত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কবি শামসুর রাহমান। স্বৈরাচারবিরোধী ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রপতি এরশাদের রোষানলে পড়ে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক পদ ছাড়তে হয়। শামসুর রাহমান পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। গ্রীক ইথাকা নগরী তখন অবরুদ্ধ- টেলেমেকাস ব্যথিত, তার স্বদেশের বন্দিত্বের জন্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানও (বাংলাদেশ) ছিল শাসকের হাতে বন্দী, বার বার হয়েছিল অপমানিত। গ্রীক বীর টেলেমেকাসের মতো বাংলাদেশের জনতাও অপেক্ষায় আছেন, নেতা শেখ মুজিব আসবেন কারাগার ভেঙ্গে, শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করবেন বাংলার জনগণকে- এই বিষয়টিকে উপলক্ষ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়/কখনো তোমার মুখ হবে না উদ্ভাসিত, পিতা/পুনর্বার? কেন আজও শুনি না তোমার পদধ্বনি/... ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়/ এখনো ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার/বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ূধ/আবার অভিজ্ঞ হাতে তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?’ তিনি ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’ কবিতায় সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেনÑ ‘শেষ হয়ে আসা অক্টোবরে.../কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে/ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে, হামলাকারীরা/ট্রাম্প বাজিয়ে ঘুরে শহরে ও গ্রামে...’ যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। রচনা করেছেন ‘বন্দি শিবির থেকে’ ‘নিজ বাসভূমে’ ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ ‘ইকারুসের আকাশ’ ‘অবিরাম জলভ্রমি’ ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’ অস্ত্রে আমার বিশ^াস নেই’ ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যগ্রন্থÑ যেখানে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা, ‘ঘুমের খাটে শঙ্খমালা ঘুমন্ত/কৌটো-খোলা ভোমরা মরে জীবন্ত/ ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধান্ধায়/ ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায়/...সেই চালে ভাই মিত্র কিবা সত্তর/চলছে সবাই মস্ত সহায় হাতির শুঁড়। কবিতাটি সেই সময়ে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচিত ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় লিখেছেন- ‘শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়/ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ/ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার/ বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, রক্ত ঝরতে থাকে।’ সত্তরের নবেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বার বার/অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি/যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব/ বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় বলেছেনÑ ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ¦লজ¦লে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়/মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়/ঘিরে রয় সর্বদাই...!’ এমনিভাবে একাত্তরের পটভূমিতে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ‘গেরিলা’ ‘কাক’ কবিতাগুলোতে উচ্চারিত হয়েছে এ দেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট উঁচুতে তুলে ধরে প্রতিবাদী এক বিশাল মিছিলের মুখোমুখি হওয়া কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে এ কবিতায়Ñ ‘ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত/ মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চূড়োয়/গমগমে এভিন্যুর আনাচেকানাচে/ উড়ছে, উড়ছে অবিরাম।’ এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্য ভাষ্যকার। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর।’ কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদও করেছেন। এর বাইরে গীতিকার হিসেবেও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্ত্যমিল ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে’ ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে’ ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে’র মতো বিখ্যাত গান। মৃত্যু নিয়ে শামসুর রাহমান প্রায়ই ভাবতেন। তাঁর ভাবনার মধ্যে মৃত্যু ছিল বলেই হয়ত ‘ইচ্ছা’ নামক কবিতায় নিজের সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করেছিলেন, ‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি/ লিখবো/...যদি বেঁচে যাই একদিন আরো/ লিখবো।’ তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে যা লিখে গেছেন তা হয়তো দশকের পর দশক মানুষ পড়ে যাবে, গবেষণা হবে। কিন্তু কবি তা অবলোকন করতে পারবেন না। বেঁচে থাকতে কি তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘যেদিন মরবো আমি, সেদিন কী বার হবে, বলা মুশকিল/শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার/ যে বারই হোক/ সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা/না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথ-ঘাট/পুণ্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।’ ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট যখন তিনি চলে গেলেন চিরন্তন এক মহাযাত্রায়- তখনও আলনায় ঝুলেছিল তার সাদা জামা, যমজ কবরের মতো জুতা জোড়া পড়ে ছিল ঘরের এক কোণে, কবিতার নগ্ন খাতায় বায়োগ্রাফিতে লিখা হয়েছিল।
×