ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

একাত্তরের বহুমাত্রিক বয়ান

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২০ অক্টোবর ২০১৭

একাত্তরের বহুমাত্রিক বয়ান

সময়কে ধারণ করে থাকে জীবন ও ইতিহাস। হাজার বছর ধরে পথ পরিক্রমায় মানুষ যে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেÑ তার পেছনে রয়েছে কণ্টকাপূর্ণকে জয় করার মানসিকতা ও গৌরবময় পথচলার হাতছানি। বলা হয়ে থাকে আন্দোলন ও সংগ্রাম ব্যতীত জাতিগতভাবে বড় কোন মুক্তি সম্ভব নয়। পরাধীনতা ঘোচাতে, বঞ্চনা দূর করতে সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ গড়ার পেছনেরও রয়েছে এমন এক শক্তিশালী জাতিগত আন্দোলন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমরা অর্জন করতে পেরেছি স্বাধীনতা। যে একটি দেশ, একটি ভূখ-, সার্বভৌমত্ব, একটি পতাকা আমরা স্বাধীনতার মাধ্যমে পেয়েছি, এই স্বাধীনতায় অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ উজ্জ্বল হয়ে আছে এ দেশের মাটির পরতে পরতেÑ তাই স্বাভাবিকভাবে বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। প্রবীণ লেখক নীলুফার বেগমের ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই লেখা একটি গ্রন্থ। এই বইটিতে কেবল স্মৃতিকথাকে স্থান দেননি লেখক, স্থান দিয়েছেন নিবন্ধ এবং গল্পকেও। অর্থাৎ এই গ্রন্থ পাঠে স্মৃতিকথা, নিবন্ধ ও গল্পের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা ও চেতনা লাভ করতে পারবে পাঠক। এ রকম বিষয়বৈচিত্র্যের গ্রন্থ যে বাংলাদেশে কম, তা বিশেষ করে বলতে হয়। নীলুফার বেগম মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, অনুভব করেছেন এর ভয়াবহতা। প্রাণপণে সহযোগিতা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’র পূর্ব কথায় সে কথা তার মুখ থেকেই আমরা শুনতে পাই। তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমরা যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সরকারী কর্মকর্তা নিপা অফিসে কাজ করতাম, দু’চারজন ছাড়া সকলেই ভেতরে ভেতরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করেছিলাম। আমরা ওই অফিসের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সকলে চাঁদা তুলতাম, ওষুধ সংগ্রহ করতাম, খবরাখবর বা তথ্য বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছাতাম।’ নীলুফার বেগমের গল্পগুলোর চেয়ে স্মৃতিকথাগুলো বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। শব্দ চয়নেও তিনি সাবলীল ও সহজতার আশ্রয় নিয়েছেন। ‘বিজয়ের মাসে আমরা রউফকে হারিয়েছি’ রচনায় নীলুফার বেগম লিখেছেন, ‘ওঁ (রউফ) ছিল আদি অকৃত্রিম। সেই আদি অকৃত্রিম মানুষটার ভেতরে ছিল খাঁটি দেশপ্রেম। তাই বিনা দ্বিধায় ঢেলে দিয়েছিলেন দেশের কাজে অর্থ। আর্থিক সচ্ছলতা তার ছিল না কিন্তু পরোয়া করেননি তিনি। ...স্ত্রীর পরনের শাড়ি তেনা তেনা হয়েছে, ছোট্ট আত্মজদ্বয় মিলন ও কিশোরের গায়ে নেই শীতের কাপড়, নেই ভবিষ্যতের কোন সঞ্চয়। কিন্তু সব কিছুকে উপেক্ষা করে বেতনের একটা মোটা অংশ তুলে দিতেন মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের হাতে।’ শুধু রউফ নয়। আমরা জানি রউফ কেবল প্রতীক মাত্র। এমন হাজার হাজার রউফের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। এই গ্রন্থে রউফ ছাড়াও আমরা রাবিয়া খাতুন, ড. সাত্তার, মোঃ সফিকউল্লাহ, মিসবাহউদ্দিন খানসহ বিভিন্ন চরিত্রের মুখোমুখি হই। তারা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। নীলুফা বেগমের পরিচিত এই মানুষগুলো যে খুব ব্যাপকভাবে পরিচিত তেমন নয়। কিন্তু এই মানুষদের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার পথে সাধারণ মানুষের যে কত আত্মত্যাগ, কত নিষ্ঠা ছিলÑ তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বইটি রচনার উদ্দেশ্যও ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে প্রজন্মকে অবহিত করা। গ্রন্থটি সম্পর্কে ফ্লাপে বলা হয়েছে : ‘বর্তমান প্রজন্ম বইটি পড়লে তখনকার পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানুষে-মানুষে ঐক্যবোধ, দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশের স্বাধীনতার পেছনে নারী-পুরুষের অবদান, তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে দেশের মানুষের প্রতি তাদের মমত্ববোধ বাড়বে।’ দিন বিগত হবে। সময় বাহিত হবে। বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে। প্রজন্ম থেকে নতুন প্রজন্ম আসবে। কিন্তু যতদিন বাংলাদেশ আছে ততদিনই মুক্তিযুদ্ধ মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত থাকবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’র মতো গ্রন্থগুলো শত শত বছর ধরে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার কথা নতুন প্রজন্মকে জানাবে, অনুভব করাবে সংগ্রামের সেই দিনগুলোর কথাÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’ প্রকাশ করেছে আহমদ পাবলিশিং হাউস। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুদ কবির। ৭২ পৃষ্ঠার গ্রন্থের মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা।
×