ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জীবন দোলে ঢেউয়ের তালে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২০ অক্টোবর ২০১৭

জীবন দোলে ঢেউয়ের তালে

‘সব পাখি ঘরে ফেরে সব নদী’ জীবনানন্দ দাশ তার বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ এ লিখেছেন। সব পাখি হয়তো ফিরে, তবে সব জেলে ঘরে ফেরে না। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ডাকাতের আক্রমণ ছাড়াও এক ঘাতক আছে। যা জেলেদের অকালে শেষ করে দেয়। তার নাম নিউমোনিয়া। এ রোগ ধরা পড়তে পড়তে সমুদ্র থেকে ফেরা তারপর তাবিজ, কবচ পানিপড়া, সব শেষে গঞ্জের ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে জীবন শেষ। জেলে পাড়ায় এজন্য বাল্যবিধবার সংখ্যা বেশি। চট্টগ্রামের আনোয়ারা বা ভোলার তজিমুদ্দীনের চাঁদপুর জেলে পল্লীর বাস্তবতা এমনই। আনোয়ারার জেলেপাড়ার হরিদাস জলদাস বলেন, হিন্দু বিধবাদের জেনে শুনে কোন ছেলে বিয়ে করতে চায় না। তাই তাদের ভারতে নিয়া বিয়ে দিতে হয়। তাতেও যে টাকা-পয়সা লাগে, কলকাতায় যাওয়া-আসা এটা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। এটা করার শক্তি জেলেদের নেই। যদিও আগের মতো ডাকাতের ভয় নেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরজারি নেই, ডাক্তার এখন হাতের কাছেই পাওয়া যায়। মোবাইলে প্রায় প্রতিদিন কথা হয়। সুবিধা অসুবিধার আদান-প্রদান হয়। তারপর জেলেপাড়ার আঙ্গিক এখনও বদলায়নি। চাঁদপুরের মোবারক মিয়া জানান, আগে হিন্দুরাই জেলে ছিল, দাস, জলদাস, বর্মণরা মাছের জন্য নদী-সাগর ঘুরে বেড়াত। বিভিন্ন সময়ে তারা অনেকে দেশ ছেড়ে গেছে। আবার শিক্ষিত অনেকে পেশা ছেড়েছে। এর মধ্যে লোক বেড়েছে। কাজের সঙ্কট বেড়েছে, ফলে জলদাসদের ব্যবসায় এখন মুসলমানরাও জায়গা করে নিয়েছে। তবে জেলেরা গরিব গরিবদের মধ্যে কোন ভেদ. বৈষম্য নেই। আমরা এক নৌকায় মাছ ধরি, মাসের পর মাস পড়ে থাকি সমুদ্রে। আড়তদার ঠকানোর সময় হিন্দু-মুসলমান দেখে না। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা ডাকাতের আক্রমণ জাত-পাত দেখে না। আমাদের পাড়ায় ঢুকলে দেখবেন হিন্দু-মুসলমান কে, তা টের পাবেন না। চাঁদপুর জেলেপাড়ায় ঢুকে যে চিত্র চোখে পড়েছে তার বর্ণনা বহু বছর আগে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ দিয়েছেন- ‘ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তক্লি- সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।’ ‘নদীভিত্তিক সমাজের পরিবেশগত বাস্তব পরিচয়ে চিহ্নিত এই মালোপাড়া। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের দ্বিতীয়পর্ব ‘প্রবাসখণ্ড’ এভাবেই মালোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দৃশ্যপট উšে§াচন করে। সঙ্গে সঙ্গে মালোজীবনের গভীর সত্য ও বৃহত্তর সংগ্রামী জীবনের ইঙ্গিত এ-পর্বকে বিশিষ্ট করে তোলে। কিশোর, বাসস্তী ও সুবলকে ঘিরে কারণ্যময় যে-জীবন তা ‘এখানে আভাসে প্রকাশিত। ’( তিতাস একটি নদীর নাম/ অদ্বৈত মল্লবর্মন) তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কিশোর বাসন্তীদের থেকে মালোপাড়া খুব বেশি এগোয়নি। জেলেদের নিয়ে লেখা নিয়ে লেখা আরেকটি উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’র কেতুপুর বা কুবের, হোসেন মিয়ারা এখনও পড়লে সহজেই মনে হবে, পৃথিবীর সবখানে বদল হলেও জেলে পল্লীগুলো এখনও একশ বছর পিছনে পড়ে আছে। দিন বদলায় নতুন দিন আসে চালান বাবুদের নাম বদল হয়। হোসেন মিয়ারা বদলে যায় কিন্তু সমুদ্র বা নদী পাড়ের জেলে পল্লীগুলোতে গেলে মনে হবে জেলে জীবনে কোনদিন আধুনিকতা আসেনি। পাড়ায় ঢুকলে জালের আশটে গন্ধ আসে। অল্প জায়গায় ছোট খুপড়ি ঘর। তার মধ্যে ৫/ ৬টা বাচ্চা নিয়ে মা শুয়ে থাকে। শঙ্কা জাগে হঠাৎ গতরে কারও হাত না লাগে। হীরামতি বর্মণ জানায়, সে (স্বামীর নাম বলা পাপ) থাহে সাগরে আর এদিকে মানুষ খালি এডা ওডা কয়। বাজে ইশারা দেখায়। এরমধ্যে মহাজনের লোকজন আছে কিনা জানতে চাইলে, চুপ করে থাকে। হঠাৎ করে নীরবতা যেন তাকে গলাটিপে ধরে। সে কথা বলে না। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করবে এটা হয়? প্রসঙ্গ বদল করে ‘মাশান’ পূজার কথায় যাই। মাশান সমুদ্রের দেবতা। জেলেরা মাশানের পূজা করে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো হিন্দু মুসলমান বোঝে না। তাই মাশানের পূজা হয় সমুদ্র যাত্রার শুরুতে। ট্রলারে মহাজনের রঙিন পতাকা দোলে। মাছ যাতে বাইরে বিক্রি না করে মূলত এজন্য মালিকরা নির্দিষ্ট একটা রঙের পতাকা বেঁধে দেয়। দাদনের যাতনা থেকে মুক্তিহীনতার প্রতীক বহন করে চলে এসব পতাকা। ‘পদ্মা নদীর তীরবর্তী কেতুপুর গ্রামের জেলেপাড়ায় বসবাসকারী জেলেরা খুবই অসহায় ও হতদরিদ্র। পাড়ার সবাই জেলে হলেও তাদের অধিকাংশই মাছ শিকারের জন্য জাল কিংবা নৌকা কোনটাই নেই। যে কারণে এই হতদরিদ্ররা প্রভাবশালী মহলের শোষণের শিকার। শেতল বাবুর মতো প্রতারকেরা ছল-চাতুরির মাধ্যমে বিনা পয়সায় এদের মাছ হাতিয়ে নেয়। সময়-সুযোগমতো চালান বাবুরাও এদের ঠকায়। নৌকা ও জালের মালিকেরাও তাদের নানা কৌশলে ঠকায়, শোষণ আর বঞ্চনাই যেন তাদের নিয়তি। অপরদিকে, প্রকৃতিও তাদের অনুকূলে নয়। বর্ষার জল ভাসিয়ে নেয় তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। নড়বড়ে ঘরগুলো সামান্য ঝড়েই বিধ্বস্ত হয়। রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু এখানকার জেলেদের নিত্যসঙ্গী। তাদের এ করুণ অবস্থা দেখে মনে হয়, তাদের প্রতি ঈশ্বরও যেন মুখ তুলে তাকান না। ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে এখানে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ (পদ্মা নদীর মাঝি/ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) পদ্মা নদীর মাঝির এ বাস্তবতা এখনও রয়েছে। এখনও জেলেদের মাছ বিক্রি করতে হয় বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে। লোকদেবতা মাশান সমুদ্র দেবতা। সে খুশী থাকলে বিপদ আপদ হয় না। এক জেলে পল্লীর সব জেলেরা এসে হাজির হয় মাশান পূজায়। সাগর পাড়ে পূজার আয়োজন হয়। মাশানের মূর্তি কেমন? তা কেউ জানে না। তবে জলের পাগলামি মাশান কে কেমন তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয়। কেউ মাশানের মূর্তি দেখেনি। মাশানের পূজার আগে ঠাকুরবাড়ি যায়। ঠাকুর মহাশয় একটা শরার ওপর খড়িমাটি দিয়ে কয়েকটা টানটোন দেয়। এটাই মাশানের মূর্তি। মাশান পূজার দিন জেলে পাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন আসে ঘাটে। যে ঘাট থেকে নৌকা ছাড়া হবে। তারপর জেলেদের মধ্যে বয়স্ক যে তিনি পূজায় বসে কি মন্ত্র বলেন তা অন্য কেউ বোঝে না। ট্রলার ছাড়ার আগে জেলেরা স্ত্রীদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে ট্রলারে ওঠে। বউয়ের বয়স কম। এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। বাল্য বিয়ে এখানে ঠেকানোর কেউ নেই। ২০ বছর হতে না হতেই ৩ সন্তানের মা। বিদায়ের ওই মুহূর্তে কোলে একজন সঙ্গে একজন বা দুজন নিয়ে কাঁদতে থাকে বউ। কারণ সে দেখে এসেছে তা মা, মাসি, পিসিদের। কত অল্প বয়সে তারা বিধবা হয়ে গেছে। বউ পরিজন কাঁদতে থাকে আর জেলেরা খুব মন খারাপ করে- বউদের ঘরে যেতে বলে। কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে নিষেধ করে। পাড়ার লোকজন কোলাকুলি করে। হয়তো আর কোনদিন দেখা না হতে পারে এমন ঘটনাই বেশি থাকে। জেলেরা ফেরে না কেন? সমুদ্রে ডাকাত হানা দেয়। জাল কেড়ে নেয়, মাছ ট্রলার কেড়ে নেয়। জেলেদের জিম্মি করে টাকা নেয়। টাকা না পেলে জেলেদের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অবধারিত মৃত্যু থেকে কেউ ফেরে কেউ ফেরে না। সমুদ্রে মাছ শিকার করতে করতে জেলেরা গভীর সমুদ্রে চলে যায়। তারপর ঝড় দেখা দিলে সংকেত শুনলেও কোন ট্রলার ফেরে কোন ট্রলার ফিরতে পারে না। যারা ফিরতে পারে না তাদের খবর কোন কোন ট্রলার দিতে পারলেও স্বজনরা বিশ্বাস করতে চায় না। এরপরও মাসের পর মাস স্ত্রী, স্বজনরা তাকিয়ে থাকে রঙিন পতাকাওয়ালা ট্রলারের দিকে। যদি মাস্তুলের দেখা মেলে। তারপরও সমুদ্রচর জেলেদের একমাত্র অবলম্বন বঙ্গোপসাগর। যেখানে ঢেউয়ের তালে জীবন দোলে। ২. বঙ্গোপসাগর। এখানে ইলিশের বাস। এখান থেকেই নতুন জলের গন্ধে ইলিশরা ছুটে চলে সমুদ্র ছেড়ে আরও ভেতরে। অর্থাৎ আমাদের দেশের ভেতরের নদীগুলোয় ছুটে চলে ইলিশ। এই ছুটে যাওয়া কেন? এসব আমরা জানি না। যারা জানে তাদের কথাই বলতে চাই এই রচনায়Ñ কে শোনে কার কথা? ইলিশ-জেলে তবারক। গায়ের রং শুধু কালো নয়, কালোর ভেতরেও কিসের যেন একটা মিশ্রণ। জলে ডুবাতে ডুবাতে সিধলা পড়া শরীরের রংটা স্থায়ী হয়ে গেছে। চিতানো বুক, উঠতি বয়স, বিয়ে করেছে সম্প্রতি। তার বয়স ২২ আর বউয়ের ১৪। এত কম বয়সে বিয়ে করেছ কেন? প্রশ্ন করলে তবারক উত্তর দেয়Ñ আমি তো করি নাই, মায় শক কইরা দিছে। বউ বাড়িতে থাকে আর তবারক ইলিশের মৌসুমে রাতভর ইলিশ ধরে। আমাদের বঙ্গোপসাগরটি অত্যন্ত ক্রুব্ধ স্বভাবের। সব সময়ই উত্তাল থাকে এটি। বঙ্গোপসাগরের এই উত্তাল ঢেউ ইলিশের যেমন পছন্দ, তেমনি তাদের প্রজননের জন্যও ওই সাগরের প্রভাব খুব কার্যকর। ফলে বঙ্গোপসাগর ইলিশের বাসভূমি। সে হিসেবে তার কদরও কম নয়। বৈশাখের শেষ থেকে আশ্বিন মাসের প্রথম বছরের ঋণ শোধ, মেয়ে বিয়েÑ সব কাজের জন্য জেলেদের মূল প্রস্তুতি শুরু হয় এ সময়েই। এ বছর ইলিশের মৌসুম যাচ্ছে ভালই। ব্যস্ত জেলেরা। কূলে আসতে এক মাস সময় নেয়। এ সময় জেলেদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন থাকে। ইলিশ, টাকা, ছেলে-মেয়ের বিয়ে, বউয়ের নতুন শাড়ি, বাচ্চাদের দাবি পূরণ আরও কত কি। খালি জোতদারের মুখ মনে পড়লে বঙ্গোপসাগরের ঢেউগুলোকে আর নিষ্ঠুর মনে হয়। ভোলার তজিমুদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর এলাকা। মেঘনা আর বঙ্গোপসাগর মিলেছে এখানে। বেড়িবাঁধের ওপর একটু কাত হয়ে তাকালে দুরঙা জলের সীমারেখা দেখা সম্ভব। আর কাছে গেলে উত্তাল তুফানের ভেতরেও সাগর ও নদীর মিলন মোহনা বোঝা যায়। মোহনার জল ঘোলাটে। একটা ক্রোধ জলের শরীরে থাকলেও হানাদারি স্বভাবের ছাপ নেই। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ জলরাশির ভেতরে কী নির্মম নিষ্ঠুরতা তা না দেখলে বোঝা বড় দায়। একদিকে টাওয়ারের সদৃশ তুফানের ক্ষিপ্রতা, অন্যদিকে কূলকিনারাশূন্য গতিহীন এক জীবনের দ্রোহ, যার সবটাই বেঁচে থাকার জন্য। এ বড় কঠিন বাস্তবতা। এক-একটু পর পর হাঙরের নিষ্ঠুরতা নিয়ে তেড়ে আসে কাচের টাওয়ারের মতো এক-একটা ঢেউ। আছড়ে পড়ে ইলিশ ধরা ট্রলারের পাশে। জলে ভরে যায় পাটাতন। আর ট্রলারটি ছেঁড়া কাগজের মতো দুলতে থাকে। জীবন এখানে যে কোন মুহূর্তে মৃত্যুতে পরিণত হতে পারে। অথচ এই ভয়াবহ জীবনদোলার ভেতরেও শহীদ আর তবারক বিড়ি বিনিময় করে। বউয়ের কথা নিয়ে রসিকতা করে। এই রসিকতার কোনে ব্যাকরণ নেই। তবু জীবনযুদ্ধের এক স্বরলিপি বলে মনে হয় একে। রসিকতার ভেতরে খিস্তি-খেউর, যৌন জীবনের গন্ধ মেলে, আবার তার মধ্যে বিম্বিত হয় অসহায় মানুষগুলোর স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ফলে এ রসিকতা আর রসিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাদের রসিকতার ভাষা শুনলে একে অশ্লীলতাও মনে হতে পারে। কিন্তু এটা শ্রম-ঘাম, কষ্ট ভুলে থাকার একটি বিনোদনও বটে, যা নৌকায় নৌকায় চলে। অথচ তারাও জানে একটু বেসামাল হলেই ট্রলার উল্টে নিখোঁজ হবে। তাদের প্লাস্টিকের টায়ার আর বাঁশের ভেলা কোন নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তবু সাগরের ভয়ের চেয়ে পেটের ক্ষুধার তেজ এত বেশি যে, ক্ষুধা ভয়কে জয় করতে বাধ্য হয়। রসিকতা জীবন সংগ্রামের একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। তবারক, শহীদ সবার হাতেই কমপক্ষে গণ্ডাখানেক তাবিজ-কবচ ঝুলছে। কেন ঝুলছে? প্রশ্ন করলে হাসে। এগুলো থাকলে বালা-মসিবত থাকে না। কিন্তু বালা-মসিবত এতে কি কেটেছে? এ প্রশ্নের উত্তর তারা জানে না। কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘মুরব্বিরা দিছে তাই, ক্ষ্যাতি তো কারো হবে না, কি কন?’ শহীদ, তবারক মেঘের ভাষা বোঝে, ঢেউয়ের ভাষা বোঝে, সময়ের ভাষা বোঝে। যাদের চার পুরুষ জলের ভেতরে জীবন কাটিয়েছে তারা জানবে না? তারা ‘ট্যাণ্ডেস্টার’ রেডিওকে (জেলেরা এটাই বলে) বিশ্বাস করে না। সে সবের বিপদসংকেতে বিপদ থাকে না। সব উল্টাপাল্টা সংবাদ আসে। যেদিন তারা যা বলবে তার উল্টোটা ঘটবেই, সব জেলেদেরই এই বিশ্বাস। কিন্তু সবকিছুর পরও জেলেদের সুখ নেই। চাঁদপুর অঞ্চলের জেলেপাড়ায় আর আশটে গন্ধ আসতে আরও দেরি। জ্বলে ক্ষুধার আগুন, অস্বাস্থ্য-অজীর্ণভরা চারদিক। স্কুল-কলেজ নেই। হাড্ডিসার শিশুরা সাগরের কিনারে দল বেঁধে ঝাঁপাঝাঁপি করে। ক্লান্ত হলে বাড়ি ফিরে যায়। জলেভেজা বুকে বেয়নেটের মতো পাঁজরগুলো সূর্যের আলোয় চিল্কায়। এই তাদের বিনোদন, এই তাদের দিন কাটানোর খেলা। তাদের বয়স অপেক্ষা করে সাগর বেলার জন্য। কবে তারা নৌকায় উঠবে আর উপার্জনের বৈঠা হাতে অতিক্রম করবে সাগরের ফেনিল তরঙ্গ। সাগর মোহনায় ২ থেকে ৩ হাজার জেলে ইলিশ ধরে। ১০০০ ইলিশও যদি রাত-দিনে ধরা পড়ে তাহলেও লাভ নেই। জোতদারকে দিতে দিতেই জীবন শেষ। হিসাব দেয় তবারক। মৌসুমের শুরুতে সমুদ্রে যেতে হলে ট্রলার, জাল কোল্ড স্টোরেজ, টোবা, খাবার দাবারসহ মোট খরচ পড়ে নিদেন পক্ষে ১০/২০ লাখ টাকা। টাকা দেয় মহাজন। ফলে জেলেদের ভরা মৌসুমে আগাম কষ্টের সাইরেন বেজে উঠে। কী করবে তারা? ১ কেজি যদি ১০০০ টাকা হয় তা মহাজন নেবে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। তারপর দাদন। এর মধ্যে জাল মেরামত করতে আরও ২ লাখ লাগল টাকা মহাজনের কাছ থেকে আনা হলো। সেই প্রথম ট্রলারে যে মহাজনের পতাকা উড়ল তা আর নামে না। মাঝে মধ্যে অনেক মাছ পড়ে জালে হয়ত ৬ লাখ, ৮ লাখ টাকা বিক্রি হলো সে টাকা থেকেও ২ লাখ কেটে রেখে মনটাকে একদম ভেঙে দেয়। সারা বছর এই ঋণের জালে বন্দী জীবন কার ভাল লাগে? ঘটনার শেষ এখানেই নয়। জলদস্যুও সমুদ্রের বড় একটা সঙ্কট। তারা রাতে ট্রলার চেপে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে বের হয়। জোর করে ছিনিয়ে নেয় জেলেদের জাল, টাকা, ট্রলারের মোটর ইত্যাদি। আবার কখনও জেলেদের জলে ফেলে দিয়ে ট্রলার নিয়ে উধাও হয়ে যায় নিমিষে। এ ছাড়া সমুদ্র উত্তাল থাকলে নৌদুর্ঘটনা তো আছেই। সবই আছে। আছে মহাজনের টাকার খবরদারি, আছে ক্ষুধাÑভাতের টান। শুধু ইলিশে তার অধিকার নেই। তবু ইলিশের জন্য তাকে নামতে হয় সাগরে, সাগর দোলায়, ভাসায়, ভাসে সন্তান-প্রিয়তম মানুষের মুখ। কিন্তু এসব জানা, সব দেখা সত্ত্বেও নামতে হয় ক্ষুধার সাগরে। যেখানে গেলে লবণ-জলে মায়ের মুখখানা ছাড়া আর কোন আশ্রয় চোখের চতুষ্কোণে ভেসে ওঠে না। ৩. সমুদ্রপাড়ের এসব ভাগ্যাহত মানুষ গণতন্ত্র বোঝে না। কিন্তু ভোট দেয়। না দিয়ে উপায় নেই। এলাকা যতই উপদ্রুত হোক, নির্বাচনের আগে ওখানে গণতন্ত্র যায়। সাত-পাঁচ আশা দেখিয়ে ভোট নেয়। সহজ-সরল মানুষরা সুন্দর মোড়কে আবৃত ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে স্বপ্ন দেখে। নির্বাচনের পরই সব মোহ ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট নিয়ে তারা আবার যুদ্ধে নামে। চলে তাদের প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রাম। ভাঙা-গড়ার মধ্যে চলতে থাকা এসব মানুষ অবলম্বন করবে কাকে? লোক দেবতা ‘মাশান’ কে না শ্রেণী-সংগ্রামকে? এ প্রশ্নের উত্তর যারা জানতে চান তারা শহর ছেড়ে চলুন ওই সব উপদ্রুত উপকূলে। জীবন যেখানে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর আরেক নাম।
×