ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

সিডও সনদ এবং বাংলাদেশে নারীর সমতা অর্জন

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২০ অক্টোবর ২০১৭

সিডও সনদ এবং বাংলাদেশে নারীর সমতা অর্জন

সিডও সনদ নারীর সমতাভিক্তিক অধিকার আদায়ের এক ঐতিহাসিক দলিল। যা জাতিসংঘ কর্তৃক প্রবর্তিত হয় ১৯৭৯ সালে। এই সনদ প্রাপ্তি নারী আন্দোলনের এক অসামান্য অর্জন। সত্তরের দশক নারী জাতির অগ্রগামী অভিযাত্রায় দুটি অনন্য বিজয় গাথার এক সমন্বিত প্রয়াস। প্রথমটি নারীর উন্নয়ন দশক আর শেষটি তারই অনিবার্য পরিণতিতে সিডও সনদ গৃহীত হওয়া। আর এই সনদের মূল বার্তাই মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে নারীর সমতা এবং সর্বাধিক অধিকারকে নিশ্চিত করা। জাতিসংঘের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ সনদের মধ্যে সিডও সনদের তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্ধাংশ জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের মর্মবেদনায় সারাবিশ্ব তোলপাড় করা আন্দোলন আর সংগ্রামের এক অপরিহার্য নীতিমালা সংবলিত সিডও সনদ আজও বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রে কতখানি সক্রিয় অবদান রাখতে পেরেছে তা সত্যিই বিবেচনার দাবি রাখে। সিডও সনদ নারীর অধিকার বিষয়ক বৈশ্ব্যিক দলিলই শুধুমাত্র নয় বরং এই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রিক ভূমিকাকেও অবিচ্ছেদ্য করা হয়েছে। সিডওর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় নারী-পুরুষের বিরাজমান বৈষম্যকে নিশ্চিহ্ন করতে বিশেষ ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়েছে। নারীর গণতান্ত্রিক, নাগরিক ও আইনী সমতাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সনদের মূল সারবত্তা। সব মানুষই সমান মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু সমাজের দীর্ঘদিন চলে আসা বহুবিধ অপসংস্কার, বিধিনিষেধ এবং প্রথার শৃঙ্খলে আটকে পড়া অর্ধাংশ নারী জাতি জন্ম থেকেই অসাম্য বৈষম্যের শিকার হয়। রাষ্ট্র তার আইনগত বিধান প্রয়োগ করে নারী-পুরুষের তারতম্যকে বিনাশ করতে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দায়বদ্ধ। আর সিডও সনদ রাষ্ট্রকে সেই মাত্রায় অধিকার দিয়ে নারী-পুরুষের সমতা সুরক্ষার ব্যাপারে ক্ষমতা প্রদান করে। আর এই ক্ষেত্রে নারী সমাজসহ সকল মানুষের গণসচেতনতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশও এই সনদটিতে স্বাক্ষর করে নারী অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। যদিও বা কয়েকটি ধারা বিশেষ করে ২ এবং ১৬.১ (গ) ধারার ব্যাপারে সরকার আজ অবধি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এই সনদে উল্লেখ থাকে নারী অগ্রগতির সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে নির্মূল করে প্রথাসিদ্ধ সমাজের অমানবিক অপকৌশলকে নিশ্চিহ্ন করে নারী-পুরুষের সমতা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের আনুষঙ্গিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। যা যে কোন নারীকে পরিবার থেকে সমাজে সকল পর্যায়ে অধিকার এবং মর্যাদাহীনতার দাসত্বে আবদ্ধ করে। প্রয়োজনে সেসব সামাজিক আবর্জনাকে সমূলে উপড়ে ফেলে প্রগতির ধারায় নতুন নিয়মকানুন আর সংস্কারের আবির্ভাব ঘটাতে হবে। বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর সমাজ বাস্তবতায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনার ধারায় নারী যেভাবে শ্রম উৎপাদনশীলতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে সেভাবে তাদের অধিকার, মর্যাদা আর স্বাধীনতার প্রাপ্ত সূচকগুলো অর্জিত হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার। অর্থনীতির মূল ধারায় কৃষি শিল্প কিংবা অবকাঠামোগত উৎপাদনশীলতায় নারী নিগ্রহের চিত্রটি একেবারে দিবালোকের মতো স্পষ্ট এবং প্রকাশিত। সম্পত্তিতে মালিকানার বিষয়টি আজও নারী নির্যাতনের একটি ঘৃণ্য ঐতিহাসিক দলিল। তবে এতসব অন্ধকারের মধ্যেও শিক্ষায় নারীরা অনেকটা অগ্রসরমান এবং তা সমতার ভিত্তিতে সম্ভাবনাময়ও। আর এই শিক্ষাই যদি নারীকে তার অধিকার এবং সম্মান অর্জনের ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে তা সিডও সনদের বাস্তবায়নই নয় বরং নারী জাতির যুগোপযোগী অর্জন আর সাফল্যও বটে। ধর্মীয় মৌলবাদের বিরূপ আগ্রাসনে নারী সমাজের যে বিপন্ন অবস্থা সেখান থেকেও বের হয়ে আসতে না পারলে সঙ্কটময় পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। সিডও সনদ দাবি করে মমতার ভিত্তিতে পেশার ক্ষেত্রে নারীকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে শ্রমের মূল্যায়ন, কর্মক্ষেত্রে তার যোগ্যতার স্বীকৃতি এমনকি তার সম্মান আর মর্যাদাকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। নারীদের জন্য আরও একটি বিশেষ ব্যবস্থা গর্ভকালীন সময়ে সুরক্ষা আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মাতৃত্বকালীন প্রাপ্ত ছুটি, সদ্যজাত সন্তানের যথাযথ পরিচর্যা, মা ও শিশুর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব বলে সিডও সনদ অনুমোদন করে। আর এই প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা যদি যথার্থভাবে নারীরা ভোগ করতে না পারে তাহলে সমস্ত দায়বদ্ধতা গিয়ে বর্তাবে রাষ্ট্রের ওপর। নারী এবং কন্যাশিশুর ওপর যে পরিমাণ সহিংসতা আরোপিত হয় সেটাও সিডও সনদ সমর্থন করে না। আর এসব নৃশংসতা প্রতিবিধানে রাষ্ট্র এবং সমাজকেই অগ্রগামী ভূমিকা পাালন করা বিশেষ জরুরী। রাজনীতি ও যে কোন মানুষের মৌলিক অধিকার। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে আরম্ভ করে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশ নেয়া সবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। সমতার মাপকাঠিতে এই ধরনের অধিকার অর্জনও নারী জাতির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ কি আদৌ নারী সংক্রান্ত এসব দাবি, অধিকার কিংবা মর্যাদার ক্ষেত্রে সিডও সনদের যথাযথ বাস্তবায়নে সফল হয়েছে কিনা তা বিবেচনায় আনা বিশেষ দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এখনও সারা বাংলাদেশ নারী নির্যাতনে শিহরিত হয়, ন্যায্য মজুরি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম আর আন্দোলনে নারীরা শরিক হয় কিংবা নিরাপত্তা আর সুরক্ষার জন্য নারীকে আজও লড়াই করে যেতে হয়।
×