ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার অবশেষে চালু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২০ অক্টোবর ২০১৭

মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার অবশেষে চালু হচ্ছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে প্রথমবারের মতো নির্মিত হলো ট্রাফিক সিগন্যালযুক্ত ফ্লাইওভার। বহুল আলোচিত মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের দুটি পয়েন্টে সিগন্যাল রাখা হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌচাক-মালিবাগ এলাকার যানজটের মহাভোগান্তি নিরসনে উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ফ্লাইওভারে সিগন্যাল থাকায় যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ নতুন এ উড়াল সড়কেও নিত্য যানজটের চিত্র দেখার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ বলছে, জায়গা সঙ্কটের কারণে লুপ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই সিগন্যাল পড়েছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উড়াল সড়কে রয়েছে। কারও কারও মতে, নক্সায় ভুল হওয়াতেই উড়াল সড়কে সিগন্যাল দেয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। এদিকে দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক। আগামী ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উড়াল সড়ক উদ্বোধন করবেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি এর উদ্বোধন করবেন বলে জানা গেছে। এর মধ্য দিয়ে তিন ধাপে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। প্রকল্পের পরিচালক ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুশান্ত পালও উদ্বোধনের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমাকে মন্ত্রণালয় থেকে ২৬ অক্টোবর উদ্বোধনের কথা জানানো হয়েছে। উদ্বোধনের প্রস্তুতি শেষপর্যায়ে বলেও জানান তিনি। সরেজমিন দেখা গেছে, উদ্বোধনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। সরকারপ্রধান সময় দেয়ার পর সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার অধিদফতর। এ উড়াল সড়কের এখন ধোয়ামোছা, রং, বিদ্যুতের খুঁটি ও বাতি লাগানোর কাজও প্রায় শেষপর্যায়ে। এছাড়া সমন্বিত এ উড়াল সড়কের নিচের সড়কের সংস্কারকাজও প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া মৌচাক ও মালিবাগ মোড়ে লাগানো হয়েছে সিগন্যাল বাতিও। কেন এই সিগন্যাল ॥প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে পর্যাপ্ত ‘রাইট টার্ন’ না রাখায় শেষ পর্যন্ত ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হয়েছে। সাধারণত যানজট নিরসনে রাইট টার্নের সুবিধার জন্যই রাস্তার বদলে তৈরি করা হয় ফ্লাইওভার। অথচ যানজট নিরসনের স্বস্তির জায়গায় এ ফ্লাইওভারেই বসাতে হয়েছে সিগন্যাল। রাইট টার্ন না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক সুশান্ত পাল বলেন, মালিবাগ-মৌচাকের মতো জনবহুল এলাকায় জায়গা ছিল খুব কম। তাই আলাদা লুপ বের করা সম্ভব ছিল না। এজন্য সিগন্যাল বসানো হয়েছে। আমেরিকা, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্লাইওভারে সিগন্যাল আছে। এটা নতুন কিছু নয়। সিগন্যালের কারণে যানজটের ভোগান্তি হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা মনে করি গাড়ি নিয়মামতো চলবে। সবকিছু নিয়মমতো চললে যানজট হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, মালিবাগ ও মৌচাকের সিগন্যালে তৈরি হওয়া ঐতিহাসিক যানজট নিরসনের পরিকল্পনা থেকে এ ফ্লাইওভার প্রকল্পটি এসেছিল। অথচ সেখানেই এখন সিগন্যাল বসানো হয়েছে। এত দীর্ঘ একটি উড়াল সড়কে পর্যাপ্ত রাইট টার্নের ব্যবস্থা না রাখায় তা যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে না। তাহলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ স্থাপনা ব্যবহার করা আর ভূমির ওপর তৈরি রাস্তার মধ্যে পার্থক্যটা থাকল না। উল্টো ফ্লাইওভারের কলামগুলোর কারণে রাস্তার জায়গা নষ্ট হলো। অবাক বিষয় হলো, এখন ফ্লাইওভারের উপরে যানজট নিরসনে আবার পুলিশ বসাতে হবে। কারণ বিদেশে সিগন্যাল মানলেও আমাদের দেশে সিগন্যাল মানার প্রবণতা নেই। এছাড়াও এ ফ্লাইওভারে ওঠার পথ নামার পথের চেয়ে তুলনামূলক খাড়া। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এ ফ্লাইওভারে ওঠার দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ মিটার আর নামার ক্ষেত্রে ৩২০ মিটার। ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা বেশি ঢালু হয়, যাতে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েই ওঠা যায়। আর নামার রাস্তাটি হয় তুলনামূলক খাড়া। কিন্তু মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ ফ্লাইওভারের নক্সা করেছে একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। বিদেশে বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রাখায় ওঠা-নামার লুপে এ বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ড. সামছুল হক বলেন, বিদেশী গাড়ির কন্ডিশন এবং স্টিয়ারিংয়ের ধরন আমাদের চেয়ে আলাদা। তাই যে প্রতিষ্ঠান নক্সা বুঝে নিয়েছে তারাও এ ভুলটা ধরতে পারেনি। এ ফ্লাইওভারের কারণে গণপরিবহন ব্যবস্থা ও যাত্রী ওঠা-নামায় ভোগান্তি তৈরি হবে, যেটা হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে। আমাদের দেশে ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রবণতা এবং জবাবদিহিতা কম। ফলে উন্নয়নের নামে টাকা খরচ হয় কিন্তু জনগণের ভোগান্তি কমে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ফ্লাইওভারের পাশাপাশি এর নিচের অংশের রাস্তা, মিডিয়ান ও লেভেলিংয়ের কাজও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানেরই করার কথা এবং তা উদ্বোধনের আগেই করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, উড়াল সড়কের নিচের সড়ক ও ফুটপাথ সংস্কারকাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিন ভাগে উড়াল সড়ক ॥ ওই উড়াল সড়কটি তিন ভাগে করা হয়েছে। একটি অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। এটা নির্মাণ করেছে নাভানা কনস্ট্রাকশন। গত বছরের মার্চে এ অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর নিউ ইস্কাটন থেকে মৌচাক পর্যন্ত উড়াল সড়কের এক দিক খুলে দেয়া হয়। এ অংশ নির্মাণ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) মোড় থেকে কাওরানবাজার অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় গত ১৭ মে। এ অংশও তৈরি করেছে নাভানা কনস্ট্রাকশন। এখন খুলে দেয়ার অপেক্ষায় মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ-মগবাজার অংশ। এটা নির্মাণ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। এলজিইডি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় নয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সমন্বিত উড়াল সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ বাড়ানো হয়। প্রথমে এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভুল হওয়ায় পর নক্সায় পরিবর্তন আনা হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যয় বাড়তে বাড়তে এক হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার অর্থায়ন করেছে ৪৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ৭৭৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা দিয়েছে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি)। ২০১১ সালের ৮ মার্চ একনেক এ প্রকল্প অনুমোদন করে। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় নয় কিলোমিটার লম্বা ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এ ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ঢাকা শহরের স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (এসটিপি) অন্তর্ভুক্ত। ফ্লাইওভারটি রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। উড়াল সড়কের প্রতিটি পিলার পাইলের গভীরতা প্রায় ৪০ মিটার। ফ্লাইওভারটির আটটি মোড় যথাক্রমে- সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া ও রমনা থানা। ফ্লাইওভারটি মগবাজার, মালিবাগ ও সোনারগাঁওসহ তিনটি রেলক্রসিং অতিক্রম করেছে। ফ্লাইওভারে ওঠা-নামার জন্য পনেরোটি র‌্যাম্প রয়েছে। তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামোটর, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং শান্তিনগর মোড়ে ওঠা-নামার ব্যবস্থা রয়েছে। এযাবতকালে রাজধানীতে যে কটি উড়াল সড়ক নির্মাণ হয়েছে এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি জনভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এ উড়াল সড়কটি নির্মাণের সময়। বিশেষ করে বেহাল সড়কের কারণে যাত্রী ও পরিবহন ভোগান্তির শেষ ছিল না। এজন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনকে বারবার সতর্ক করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
×