ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এইচ এস সরোয়ারদী

অভিমত ॥ আন্তঃনগর ট্রেনের বেহাল দশা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

অভিমত ॥ আন্তঃনগর ট্রেনের বেহাল দশা

ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাব বলে গত ঊনত্রিশ সেপ্টেম্বর দুপুর দুইটা চল্লিশ মিনিটে ঢাকা থেকে উল্লাপাড়া আন্তঃনগর সিল্কসিটি ট্রেনের টিকেট কিনি যাত্রার কয়েকদিন আগেই। টিকেটে সিট নম্বর উল্লেখ ছিল বলে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাসে গেলে অনেক যানজটে পড়তে হয়, অনেক ভোগান্তি হয়, সেদিক থেকে ট্রেনে যাতায়াত অনেক ভাল হবে। ট্রেনে অনেক আরাম করে বাড়ি যাওয়া যাবে। অনেক দিন পর স্ত্রীকে সঙ্গে করে বাড়ি যাচ্ছি তাই মনটাও ছিল বেশ ফুরফুরে। যাত্রার দিন স্ত্রী আর আমি দু’জনে দুটি লাগেজ আর বাড়ির জন্য দুই প্যাকেট বনফুলের চার কেজি মিষ্টি হাতে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছলাম দুপুর দুইটায়। অথচ ট্রেন এলো তিনটা বিশ মিনিটে। ট্রেন এতটুক সময় লেট বলে তেমন চিন্তা করিনি। কিন্তু চিন্তা বাধল তখন, যখন ট্রেন স্টেশনে আসার পর এক ঘণ্টা হয়ে গেল তবুও ছাড়ল না। আশপাশে অনেক যাত্রীর কাছেই ট্রেন না ছাড়ার কারণ জানতে চাইলাম কিন্তু কেউই ট্রেন না ছাড়ার কারণ বলতে পারল না। হঠাৎ আরও একটু পর মাইকে ঘোষণা হলো, ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হওয়ায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু যা বললেন তা শুনতে অনেক কষ্ট হলো। কারণ মাইকের ত্রুটি বলে কোন কথাই বোঝা গেল না। শুধু তাই নয়, ঘোষকের মুখের কথাও অস্পষ্ট। ঘোষণাটি শুনে অনেক অবাক হলাম এই ভেবে যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কমলাপুর স্টেশনের ত্রুটিপূর্ণ মাইক আর ঘোষকের কথার অস্পষ্ট কা- দেখে। তখনই মনে হলো কমলাপুর স্টেশনের যদি এই অবস্থা হয় তবে দেশের বাকি স্টেশনগুলোর কি জানি কত বেহাল অবস্থা? সে যাই হোক, অনেক জল্পনা-কল্পনার পর দুইটা চল্লিশের ট্রেন অবশেষে ছাড়ল পাঁচটা চল্লিশে। তবে একটা বিষয় বার বার মনে হচ্ছিল, আগে আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়ার সময় বা পরবর্তী স্টেশন পাওয়ার আগে ট্রেন থেকে যাত্রীদের সতর্ক করে ঘোষণা করা হতো, আজানের সময় আজান দেয়া হতো কিন্তু এখন সেই ঘোষণা আর আজানের আওয়াজ আর নেই। আমি তারচেয়ে আরও বেশি অবাক হলাম যা দেখে তা হলো, ট্রেনের একটি বগিতে সিট আছে এক শ’ পাঁচটি, প্রতিটি সিটে যাত্রী বসে আছেন অথচ সিট ছাড়াও যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় তিন শ’ জনের মতো, এর মধ্যে অনেক মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধও আছেন। লোকের এত ভিড়ে ট্রেনে পা রাখার মতো জায়গা নেই। নড়াচড়া করার মতো কোন সুযোগ নেই। লাগেজ নিয়ে যাত্রী ওঠানামা করার মতো কোন পরিস্থিতিই নেই। এত ভিড়ে কত যাত্রীর মূল্যবান মাল খোয়া যাচ্ছে এবং কত যাত্রীর পকেট থেকে টাকা আর মোবাইল চুরি হচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? এই যাত্রী ঠাসাঠাসির মধ্যে আবার হকারের উৎপাত। হকাররা যেন যাত্রীদের বুকের ওপর পা দিয়ে হেঁটে তার পণ্য বিক্রি করছে। কোন কিছুই মানছে না তারা। ট্রেনে উঠে ভাবলাম আমি যেন বাড়ি যাচ্ছি না, বরং যুদ্ধে যাচ্ছি। আন্তঃনগর ট্রেনের এই করুণ এবং বেহাল অবস্থা দেখে খুবই হতাশ হলাম। ভাবলাম দেশ যখন সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আন্তঃনগর ট্রেনের এমন বেহাল অবস্থা কেন? যাত্রীদের অসহনীয় কষ্ট দেখার কি কেউ নেই? বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান অথচ যাত্রী সেবার মান কেন এত খারাপ? দূরপাল্লার ট্রেনে কেন যাত্রী দাঁড়িয়ে যাবে, তাও আবার প্রতিটি বগিতে শত শত। আমি এই অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমি ঐ দিনই অঙ্গীকার করেছি ট্রেনে যতদিন যাত্রী দাঁড়িয়ে যাবে ততদিন ট্রেনে যাতায়াত করব না। এটা হতে পারে এক ধরনের মৌন প্রতিবাদ। ঢাকা থেকে উল্লাপাড়া পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টার পথ, আমার পাশে আমার স্ত্রী বসেছিল কিন্তু ট্রেনের এই অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে মনের কষ্টে সারা রাস্তায় তার সঙ্গে একটি কথাও বলা হলো না। গাদাগাদি লোকের ভিড়ে আমার মুখ শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ব্যাগ থেকে পানির বোতলটি বের করে এক ফোঁটা পানিও খেতে পারলাম না। তাহলে ভেবে দেখুন যাদের কোলে এক বছরের শিশু আছে তাদের কি অবস্থা? আবার ভাবলাম, দেশ উন্নত হচ্ছে কিন্তু মানুষের মনের উন্নতি বোধ হয় তেমন হচ্ছে না। অবশেষে পৌঁছলাম উল্লাপাড়া স্টেশনে, ট্রেন থেকে নামার মতো ভাল কোন পরিবেশ পেলাম না। অনেক যাত্রী আর ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে লাগেজ নিয়ে নামার সময় শখ করে ঢাকা থেকে আনা মিষ্টির দুটি প্যাকেট কোথায় যেন হারিয়ে গেল, না কেউ কেড়ে নিল কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু স্টেশনে নেমে দেখি মিষ্টির প্যাকেট দুটি নেই। তবে কি আর করা! কোনমতে এসে স্টেশনে পৌঁছলাম এটাই যেন ভাগ্য! ট্রেন উল্লাপাড়া যখন এলো তখন বাজে রাত দশটা বিশ মিনিট। এত রাতে দোকান বন্ধ, কোথায় মিষ্টি পাব? অবশেষে অনেক কষ্ট নিয়ে লাগেজ হাতে বাড়ি গেলাম কিন্তু মিষ্টি ছাড়া। যখন বাড়ি গেলাম তখন বাজে রাত এগারোটা। আমরা অনেকদিন পর বাড়ি আসছি বলে তখনও বাড়ির ছোটরা জেগেই ছিল। বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমাদের দেখতে কাছে এলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কোন মিষ্টি দিতে পারলাম না। মিষ্টি দিতে না পেরে অনেক লজ্জাই পেলাম। কিন্তু সান্ত¡না নিলাম, এই লজ্জা শুধু আমার একার নয়, এই লজ্জা স্বয়ং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষেরও বটে। কিন্তু যাদেরই এই দোষ দেই না কেন, বাড়ির ছোটরা তো রাস্তার এই দুর্ভোগের কথা কিছুই জানে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাকে ছোটদের কাছে অনেক লজ্জা পেতে হলো। কারণ ওদের হাতে একটি করে মিষ্টি দিতে পারলে ওরা অনেক খুশি হতো, আর আমিও অনেক খুশি হতাম। আমার এই ট্রেন জার্নির বিষয়টি লেখার উদ্দেশ্য কি হয়ত সবাই বুঝতে পেরেছেন। হয়ত আমার মতো সমস্যায় অনেকেই পড়েছেন। তাই আমি শ্রদ্ধেয় রেলমন্ত্রীর কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, সার্বিক দিক বিবেচনা করে এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিন, আন্তঃনগর ট্রেনে যেন সিট ছাড়া কোন টিকিট বিক্রি করা না হয়। অর্থাৎ আন্তঃনগর ট্রেনে কোন যাত্রী যেন দাঁড়িয়ে না যায়। দয়া করে আমার কথা একটু ভেবে দেখুন। আমার অনুরোধটা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করুন, যেন আমার মতো আর কাউকে ট্রেনে যাতায়াতের সময় এমন ভোগান্তিতে পড়তে না হয় এবং আর কারও মিষ্টির প্যাকেট হারিয়ে ছোটদের কাছে এমন অপমানিত হতে না হয়। লেখক : গীতিকার
×