ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুইবারের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ইফতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

দুইবারের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ইফতি

ডিপ্রজন্ম-ইফতির পরিবারের কথা শুনি- ইফতি-ছোট ভাই আছে একটা। খুব স্মার্ট। ক্লাস ফাইভে পড়ছে দিনাজপুরের আমেনা বাকী স্কুলে। বাবা আছেন। টেকনাফে অবস্থান করছেন। উনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে কর্মরত। আর মা আছেন। তবে একটু দূরে। আকাশে। স্রষ্টার কাছে। রাতের তারা কিংবা দিনের আলো হয়ে। আমার কাছে লাল সবুজের বাংলাদেশ হয়ে। ২০১৪ সালে মা গত হন। দিনাজপুরে নানাবাড়ি আর নওগাঁয় দাদুবাড়ি। তবে আমি পিওর দিনাজপুরীয়া। আর হ্যাঁ, আমার পরিবারের অন্যতম সদস্য আমার নানা। ওনার অনেক বয়স। কিন্তু এখনও ইয়াং। নানা একদম ছোট্ট থেকে আমাকে পড়াতেন। ইংরেজীর খুঁটিনাটি নানার থেকেই শিখেছি। উনি দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী মহারাজা হাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। শের মোহাম্মদ নাম। শের মানে হলো বাঘ। নানাকে ওনার স্টুডেন্টদের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সবাই বাঘের মতোই ভয় করে। কিন্তু আমার সঙ্গে ওনার সেই ভাব! পুরনো মানুষ কি না! দু’জন মামা আছেন। ওদের ঈদের জামা নিয়মিতভাবে কেড়ে নিই। বড় ভাগিনা বলে কথা। হা হা হা। নানি, দাদি, চাচা, চাচি, মামি, কাজিন- সবাই আছে। আনিকা বুশরা আছেন। উনি আমার মা, বোন দু’জন। মেধা অন্বেষণে ওর সঙ্গে পরিচয়। কাঞ্জিলাল ভাই তো একদম আমার নিজের ভাই। আরও কত শত শুনবেন বলেন? আমার আশপাশে অনেক মানুষ আছেন। যারাই আমার পরিচিত তারাই আমার পরিবারের সদস্য। ফেসবুকের ফ্যামিলি লিস্ট চেক করলেই বুঝবেন। কী? ডিপ্রজন্মও কি যুক্ত হবেন আমার পরিবারে? আপনার আপত্তি না থাকলে আমি এক পায়ে রাজি। হা হা হা। ডিপ্রজন্ম লিভ-লাইফ ইজ ভেরি ইজিতে যেভাবে সংযুক্ত- ইফতি-আমি চাই আমার আশপাশ খুব পজিটিভ চিন্তা-ভাবনার মানুষ দিয়ে পূর্ণ থাকুক। বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ মোটিভেশনাল বক্তা সীমান্ত ভাইয়া আর জনপ্রিয় স্পীকার নিহান ভাইয়ার লিভ-লাইফ ইজ ভেরি ইজি টিম তেমন পজিটিভ চিন্তা-ভাবনার মানুষে পূর্ণ। এই মানুষগুলো একেক জন একেকটা সেক্টরে খুব ভাল করেছে এবং করছে। সেতু আপু, সমুদ্র, শুহরাত আপু, আনিকা আপু-এদের কথা না বললেই না। এই মানুষগুলোর সঙ্গে লিভ টিমে কাজ করছি একজন অলস ক্রিয়েটিভ রাইটার হিসেবে। অলস বলছি এই জন্যই যে, আমি লেখা নিয়মিত জমা দিই না। খুব অনিয়মিতভাবে লিখি। তার পরেও আমাকে সীমান্ত ভাইয়া কিংবা নিহান ভাইয়া কিচ্ছু বলেন না। কারণ ওনারা বিশ্বাস করেন, যে কোন সৃজনশীল কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হলেই কেবল সেরাটা পাওয়া যায়। আমি তাই লিভকে খুব ভালবাসি। লিভের জন্য যতটুকুনই করি, মন থেকে করি। কারণ এই জায়গাটায় আমি আমার মতো কাজ করার স্বাধীনতা পাই। লেখালেখি ছাড়াও লিভে আমার কিছু কাজ আছে। যেমন, আমি লিভের দিনাজপুর উইংয়ের লিডার। লিভের যে কোন ইভেন্টের উপস্থাপনা তো আছেই। হতাশ মানুষদের মানসিক সাপোর্ট দেয়াই হচ্ছে লিভের প্রধান কাজ। সঙ্গে মানুষের কাছে জীবনের জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে তুলে ধরে লিভ। আমি আমার খুব কাছের মানুষদের দেখেছি হতাশা থেকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে। সুইসাইড করতে। যেমন- আমার মা, আমার দিনাজপুরের বন্ধু সাহস, আমার স্কুলের সিনিয়র অলি ভাইয়া এবং আরও অনেককে। বাংলাদেশের মফস্বল এরিয়াগুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেশি। তরুণদের মধ্যে বলা হতাশা খুব প্রকট আকার নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই লিভে জয়েন করা। একজন মোটিভেটর হিসেবে মানুষের মাঝে পজিটিভিটির বীজ বপন করতে চাই। পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে হেসে খেলে সভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে চাই। নিজের সবটুকু দিয়ে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে চাই। এই তো! ডিপ্রজন্ম-স্পিচে রবীন্দ্রনাথকে কোর্ট করতে গিয়ে ভারতীয় সাংবাদিককে কাঁদিয়েছিলে, পাঠকদের জন্য বল একবার ঘটনাটা। ইফতি-ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিএসএফ কনফারেন্স হলে ২০১৫ সালে একটি প্রেস কনফারেন্সে বিজিবি-বিএসএফ ফ্রেন্ডশিপ এ্যাম্বাসেডর হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে কোট করেছিলাম। বলতে বলতে আমার চোখের কোণে জল চলে এসেছিল। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সংস্কৃতির গভীর মিল- এসব নিয়েই বলছিলাম। আমি দেখছিলাম আমার শ্রোতারা কাঁদছে। বিএসএফ কর্মকর্তাদের থেকে শুরু করে ভারতীয় সাংবাদিক- সবার চোখে আবেগের ঝিলিক। কনফারেন্স শেষে এক সাংবাদিক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। ঠিক সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল, যেন একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে স্নেহের আলিঙ্গনে নিমগ্ন হলো। সাংবাদিক হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল, আমিও তাই। কয়েকদিনের মাথায় ভারতের দ্য স্টেটস ম্যান পত্রিকায় একটি ফিচারে আমার বক্তব্য নিয়ে বিশেষভাবে লেখা হলো। সেখানে একটা লাইন ছিল এ রকম- ‘বাংলাদেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুর থেকে আসা শাকিল রেজা ইফতির বক্তব্য সবার খুব ভাল লেগেছে।’ এই মুহূর্তটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা পাওয়া। ২০১৬ সালে আমি কলেজ থেকে ভারতে গিয়েছিলাম আবারও। একটা ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্টে। লক্ষেèৗয়ের সিটি মন্টেসরি স্কুলে। গিনেস বুক অব রেকর্ড অনুযায়ী সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্কুল। ওই ইভেন্টে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার অনেক সখ্যতা হয়। আমরা একসঙ্গে খেয়েছি, খেলেছি, ঘুরেছি। ডিজে নাইটে একসঙ্গে সব দেশের প্রতিনিধি নেচেছি। জীবনে সেই প্রথম আমি নাচি। ওই ইভেন্ট শেষে দেশে ফেরার সময় আবার ঘটল কান্নাকাটির রোল। ইন্ডিয়ার ঝাড়খে র থনিখুজিল ম্যাডাম আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আবার জীবনে দেখা হবে কি না জানি না। একটা বার শুধু মা বলে ডাকবা বাবা?’ বলেই উনি হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ব্রাজিলের ফেলিপ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে, বলল, ‘ইফতি, বাঙালীরা এতটা আন্তরিক হয়- তোমার সঙ্গে না দেখা হলে কখনও বুঝতেই পারতাম না। ‘খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। এভাবেই ভ্রাতৃত্বের টানে কাঁদতে চাই আজীবন। করে যেতে চাই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব। হয়ে উঠতে চাই পুরো বিশ্বের খুব কাছের একজন। ডিপ্রজন্ম-সহশিক্ষা কার্যক্রমে সমন্বয় ঘঠাও যেভাবে- ইফতি-প্ল্যান করে চলি। টার্গেট বেঁধে নিই। এই যেমন-সামনের ৭টা দিন আমি একাডেমিক পড়াশোনার এই এই চ্যাপ্টার শেষ করব। প্রতিদিন পড়ার ফাঁকে হয়ত একটা লেখা রেডি করব। ক্যালেন্ডারে প্রোগ্রাম দাগিয়ে রাখি। কোন কোন দিন কোথায় কোথায় প্রোগ্রাম। ডায়েরিতে নোট করে রাখি। এক কথায় খুব ক্যালকুলেটেড সময় অতিবাহিত করি। সাময়িক কিছু হেরফের হলে হতাশ হই না। বরং আবার নতুন করে ছক আঁকি। আগামী ২ বছরে কিংবা ২০ বছরে কী কী করতে চাই, মাঝে সাঝে সেটারও একটা লিস্ট করে ফেলি। তবে আর যাই করি না কেন, প্রতিদিন স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই, মাকে মনে করি। পৃথিবী আর পরিবারের সবার জন্য দোয়া করি। এই কাজটুকুর জন্য কোন রুটিন লাগে না। ডিপ্রজন্ম-তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন- ইফতি-চলুন! সবাই ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সাইটে নিজেদের ভাল ভাল আইডিয়াগুলো শেয়ার করি। কোন পরিশ্রম কিংবা কাজই ফেলে দেয়ার না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের তরুণদের জীবনের একদম প্রথম থেকেই অর্থোপার্জন করার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। হতে পারে, ছোট খাটো বিজনেস, কিংবা অন্য কিছু। তবে কাজটা যদি নিজের প্যাশনকে অনুসরণ করে করা হয়, এর থেকে ভাল সত্যিই আর কিছু হয় না। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের একজন হিসেবে আমি মনে করি, নিজের পরিচয় স্বীকার করা এবং স্বকীয়তা বজায় রাখা সবচেয়ে বড় স্মার্টনেস। এই যেমন, আমি দিনাজপুরের ছেলে, ঢাকায় থাকি। ঢাকার আর ১০ জনের কাছে হয়ত আমার হেয়ার স্টাইলটা মানানসই না, হয়ত আমার পোশাক আশাক ঢাকার অন্যদের মতো নয়-কিন্তু আমার যা, তা একান্তই আমার। ঢাকায় এসে আমি আমার জেলা দিনাজপুরকে এবং দিনাপুরের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করছি, ঠিক একইভাবে দেশের বাইরে গেলে আমি বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করি। আমার স্বকীয়তাই আমার অহঙ্কার, আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই বোধটা আমাদের সবার মধ্যে থাকলেই কেবল দেশের যে কোন ক্রাইসিসে আমরা এক হয়ে কাজ করতে পারব। আমরা এগোচ্ছি, আরও অনেক পথ বাকি।
×