ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শীঘ্রই বাণিজ্য সচিব পর্যায়ে বৈঠক

বাংলাদেশ-ভারত ২২বর্ডার হাট চালুর পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

বাংলাদেশ-ভারত ২২বর্ডার হাট চালুর পরিকল্পনা

এম শাহজাহান ॥ সীমান্তে বর্ডার হাট কার্যকরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সামনে রেখে দু’দেশের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সীমান্ত এলাকায় বৈধ বাণিজ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে ২২টি বর্ডার হাট চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে দু’দেশের। হাটে বেচাকেনার জন্য পণ্য সংখ্যা ৪৭ থেকে বাড়িয়ে ৬০টি করা হতে পারে। বর্তমান বর্ডার হাটে কৃষি, হস্তশিল্পজাত ও খাদ্যসামগ্রী চানাচুর-বিস্কুটের মতো পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভারি শিল্পে উৎপাদিত হয় এমন পণ্য বিক্রির চিন্তা-ভাবনা চলছে। এছাড়া বর্ডার হাটে বেচাকেনার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তা শিথিল করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। বর্তমান কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, ফেনী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে চার বর্ডারে হাট চালু রয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে আরও ছয় বর্ডার হাট চালু করার উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত। এসব হাট হলো মৌলভীবাজারের জুড়ীর পশ্চিম বটুলী ও উত্তর ত্রিপুরার পালবস্তী, কমলগঞ্জের কুরমাঘাট ও কামালপুরের ধলাই, বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্তের সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ের ভোলাগঞ্জ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সায়দাবাদ ও মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি পাহাড়সংলগ্ন নালিকাটা, মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলসের রিংকু ও সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজারের বাগানবাড়ি, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ভুঁইয়াপাড়া ও মেঘালয়ের দক্ষিণ গারো পাহাড়ের শিববাড়ি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে গত বছর পাঁচ বছরের জন্য ভারতের সঙ্গে বর্ডার হাট চুক্তি নবায়ন করেছে সরকার। শীঘ্রই রাজধানী ঢাকায় এবার বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত বছর দিল্লীতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বৈঠক সামনে রেখে কার্যপত্র প্রায় চূড়ান্ত করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, এবারের বৈঠকে আরও যেসব বিষয় গুরুত্ব পাবে তা হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে অবকাঠামো উন্নয়নে কৌশল নির্ধারণ, শুল্ক স্টেশনগুলো ডিজিটাইজেশন পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়া, সীমান্ত হাটের অবকাঠামো উন্নয়ন, ভিসা সহজ প্রাপ্তি, ভারতের আরোপিত সিভিডি প্রত্যাহার, বাংলাদেশের তৈরি পাটের ব্যাগ ভারতে রফতানির সমস্যা দূর করা, বিশেষ করে পাটপণ্য রফতানি এ্যান্টি-ডাম্পিং আরোপ প্রত্যহার, স্থল বন্দরগুলোর উন্নয়ন, খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তে ফেনী নদীতে সেতু নির্মাণ, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর করতে উদ্যোগ। এছাড়া ভারত থেকে কমলা জাতীয় ফলের আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার, ভারতীয় দুগ্ধজাতীয় পণ্যের বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশ, ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী মাল্টিপল ভিসা চালু, এদেশে ভারতের বিনিয়োগ, বিবিআইএন দ্রুত কার্যকর, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ভারতের সহযোগিতা প্রভৃতি। ভারত থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা এবং কুমিল্লা দিয়ে বাংলাদেশে যথাক্রমে ৫০০ ও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি হচ্ছে। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু ভারতের নতুন গাইডলাইনের কারণে এর দাম বেড়ে যাবে। তাই দাম বৃদ্ধি এড়াতে কর মওকুফ বা হ্রাসের বিষয়টি আলোচনা করা হবে। জানা গেছে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে তাদের রফতানিকৃত ২২৫ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু দেশীয় পণ্যকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছিল না। তবে গতবারের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের স্পর্শকাতর ২২৫ পণ্য তালিকা থেকে ২৩ পণ্যকে ছাড় দেয়া হয়েছে। এবারের বৈঠকে পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মদ ও অস্ত্র ছাড়া বাংলাদেশের সব পণ্য রফতানির ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে ভারত। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে আগামীতে আস্তে আস্তে কোন স্পর্শকাতর পণ্যের ওপরই হয়তো বা শুল্ক থাকবে না। বর্ডার হাট বাড়ছে সীমান্ত এলাকার বাণিজ্য বাড়াতে বর্ডার হাটের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। বর্ডার হাটে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও জুতা জাতীয় পণ্য বেচাকেনার প্রস্তাব দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতীয় শাড়িতে বাজার দখল হয়ে যায় কিনা-সেই বিষয়টিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বর্ডার হাটের ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধেও লোকজন কেনাবেচায় অংশ নিতে পারেন। নতুন করে এটি বাড়িয়ে ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধেও লোকজনকে কেনাবেচার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে সংশ্লিষ্ট জেলায় উৎপাদিত কৃষি ও তৈরি পণ্য ছাড়াও বর্ডার হাটে দুই দেশের অধিবাসীরা মেলামাইন ক্রোকারিজ, ফলের জুস ও ট্রয়লেট্রিজ জাতীয় শিল্প পণ্য ছাড়াও স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কৃষিজাত পণ্য, তাজা ও শুঁটকি মাছ, ডেইরি বা পোল্ট্রি পণ্য, কাঠ ও বেতের তৈরি পণ্য ও হস্তশিল্পজাত পণ্য কেনাবেচা করছেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ইস্যুকৃত যৌথ ইশতেহারের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত জনগণের সুবিধার জন্য পাইলট ভিত্তিতে বর্ডার হাট স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ২৩ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে বর্ডার হাট সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। ওই চুক্তিতে পাইলটভিত্তিতে দুটি বর্ডার হাট স্থাপনের কথা থাকলেও এরপর দুই দেশের সরকারের সম্মতিতে এ পর্যন্ত চার বর্ডার হাট স্থাপন হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে মহাজোট সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সীমান্ত হাট। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা সদর থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরে ভারতের কালাইরচর সীমান্তের বিপরীতে বাংলাদেশের বালিয়ামারী সীমান্তে প্রথম বর্ডার হাট উদ্বোধন করা হয়। সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী দু’দেশের ৪৭টি করে পণ্য বেচাকেনার কথা। কিন্তু নানা জটিলতায় দীর্ঘদিনেও বর্ডার হাট কাক্সিক্ষত সফলতা আসেনি। কি উপায়ে এসব হাট আরও যুগোপযোগী করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানো যায় সে বিষয়ে এবার কৌশল গ্রহণ করা হবে। যেসব এলাকায় নতুন বর্ডার হাট হতে পারে ভবিষ্যতে নতুন করে যেসব এলাকায় বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডার স্থাপিত হতে পারে তা হচ্ছে- কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঘোলাশালা ইউনিয়নের জগমোহনপুর গ্রাম, কুষ্টিয়া দৌলতপুরের মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিষ্ণপুর গ্রামের দক্ষিণ অংশ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের সীমানা পিলারের মধ্যবর্তী স্থান, নওগাঁর সাপাহার শিরন্টি মৌজার খঞ্জন সীমান্ত, নওগাঁর ধামইরহাট কালুপাড়া মৌজার কালুপাড়া সীমান্ত, নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার শীতলবাজার সীমান্ত, রাধানগর মৌজার সীমান্ত, শাওলি সীমান্ত, তালতলা পাড়া শাওলি সীমান্ত, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট গাজীর ভিটা ইউনিয়নের উত্তর নলকুড়া সীমান্ত, ঝিনাইদহের মহেশপুর যাদবপুর ইউনিয়নের গোপালপুর মৌজা, নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার পাঁচগাঁও এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুর বিজয়পুর সীমান্তে। বর্ডারহাটে বেচাবিক্রির শর্তসমূহ শিথিল করা হতে পারে গত সাত বছরে মাত্র চার বর্ডার হাট চালু করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আরও ছয় বর্ডার হাট আগামী বছরের মধ্যে চালু হতে পরে। সেক্ষেত্রে হাটের সংখ্যা হবে ১০টি। বর্ডারহাট সংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপের কারণে হাটের বাণিজ্য তেমন বাড়ছে না। অথচ দেশের বর্ডার বা সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছে বর্ডার হাটের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্ডার হাট উদ্বোধনের শুরুতে দু’দেশের ২৫ জন করে মোট ৫০ বিক্রেতা পণ্যবিক্রি করতে পারতেন। দু’দেশের সীমান্ত এলাকার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে যাদের বসবাস শুধু তারাই বর্ডার হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা হতে পারবেন। ইতোপূর্বে দেড় হাজার করে দু’দেশের ৩ হাজার ক্রেতাকে বর্ডার হাটে পণ্য কেনার অনুমতি পত্র দেয়া হয়। হাটে ভিজিটর এন্ট্রি ফি হচ্ছে ২০ টাকা। সংশ্লিষ্টদের দাবির প্রেক্ষিতে এই ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা আবার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমান বর্ডার হাটের ক্রয়সীমা বাড়িয়ে ১শ’ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০০ ডলার বা ১৬ হাজার টাকার করা হয়েছে। বেচাকেনায় বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় রুপী ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এবারও ১০০ ডলার বাড়িয়ে ২৪ হাজার টাকা করা হতে পারে। এছাড়ার বর্ডার হাটের একজন বিক্রেতা দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকার মালমাল বিক্রি করতে পারেন। এবার শর্তশিথিল করে বিক্রয়সীমাও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সমঝোতা অনুযায়ী বর্ডারহাটে কেনা-বেচা হওয়া পণ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে- স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সব পণ্য, শাড়ি, হস্তশিল্পজাত পণ্য ও স্টেশনারি। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা চানাচুর, চিপস, আলু, তৈরি পোশাক, শুঁটকি, সাবান, শিম, সবজি, গামছা ও তোয়ালে, কাঠের টেবিল ও চেয়ার, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত লোহার তৈরি পণ্য বিক্রির অনুমতি পায়। অন্যদিকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ফল, সবজি, মসলা, মরিচ, হলুদ, পান, সুপারি, আলু, মধু, বাঁশ ইত্যাদি বিক্রি করে থাকেন।
×