ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নওগাঁর ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি

প্রকাশিত: ০১:০০, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নওগাঁর ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলায় এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ মত্ত সৃষ্টিতে আবার কেউ মত্ত ধ্বংসের খেলায়। এর মাঝে আবার কারো কারো অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার কারনে কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতীত ঐতিহ্যের কিছু স্মৃতি চিহ্ন। সুজলা সফলা শষ্য শ্যামলা এই বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটেয়ে রয়েছে বেশ কিছু ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো আমাদের তথা বাঙ্গালীর স্বত্বাতে আলোড়ন সৃষ্টি করে আজও। তেমনী আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক স্থান দেশের উত্তর জনপদের নওগাঁ জেলার অন্তর্গত দুবলহাটি রাজবাড়ি। নওগাঁ জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিঃমিঃ দক্ষিনে এই রাজবাড়িটির অবস্থান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযতœ আর অবহেলার কারনে ২শ’ বছরের পুরনো এই রাজবাড়িটি বর্তমানে কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সরকার উদ্যোগ নিলে এখানে গড়ে উঠতে পারে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণ নাথ লর্ড কর্ণওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪শ’ ৯৫ টাকা দিয়ে এই জমিদারীটি পত্তন নিয়ে এ রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে রাজা হরনাথ রায় এই রাজত্বভার গ্রহন করেন। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটি রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মান এবং প্রজাদের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট লাঘবে রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নামকরন করা হয় ‘রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী সপরিবারে ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল রাজপ্রাসাদটি। রাজবাড়ির প্রধান ফটকে রোমান ষ্টাইলের স্তম্ভগুরো রাজাদের রুচির পরিচয় বহন করে। রাজবাড়িতে সব মিলিয়ে ৭টি আঙিনা, ৩শ’টি ঘর এবং প্রাসাদের ভিতরে ভবনগুলো কোনটি ৩ তরা আবার কোনটি চারতলা ছিল। প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় জ্বালানো হতো সন্ধ্যা প্রদীপ। শোনা যেত শঙ্খের ধ্বনী। যা কালের বিবর্তনে আজ পরিনত হয়েছে জনমানবহীন শ্মশানে। রাজবাড়িতে এখনো সান বাধানো এঁদেরার (কুয়ো) অস্তিত্ব রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে রয়েছে বিশাল গোবিন্দ পুকুর। চারি ধারে ছিল সান বাঁধানো ঘাট। পুকুরের পূর্ব পাড়েই ছিল নাট্যশালা। যেখানে গান বাজনা, যাত্রা-থিয়েটারসহ চলতো বিনোদনমুলক অনুষ্ঠান। এই নাট্যশালার অদূরেই ছিল কালি মন্দির। যেখানে আগাছা আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কালি মন্দির থেকে মাত্র ৫শ’ গজ উত্তরে ছিল রাজার বাগান বাড়ি। বাগানবাড়ি এলাকা জুড়ে ছিল আম বাগান। স্থানীয়রা এই বাগানবাড়িকে ছোট রাজবাড়ি বলতো। এই বাগানবাড়িতে বর্তমানে দু’টি পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। বর্তমানে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে অনায়াসেই বুঝা যায়, তৎকালীন এখানকার রাজাদের ব্যাপক জৌলুস ছিল। রাজ্য বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ছিল এই রাজপরিবারের। রাজা খেতাব পেয়েছিলেন হরনাথ রায় চৌধুরী। তার পূর্বপুরুষরা মোগলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভুষিত ছিলেন। রাজ পরিবারের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ির প্রধান গেটের পাশে আবাস গড়ে তুরেছে এক ছিন্নমুল পরিবার। দোতালায় কয়েক বছর থেকে কবুতর পালন করছে স্থানীয় এক যুবক। জমিদারী বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকার এই রাজবাড়িকে সরকারী সম্পদ হিসেবে গ্রহন করে দেখভালের দায়িত্ব দেয় প্রত্নতত্ব বিভাগকে। প্রতœতত্ব বিভাগ দায়িত্ব গ্রহন করলেও এই প্রত্ম সম্পদটি রক্ষনাবেক্ষন বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি এখনো। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পড়ে দিনের পর দিন রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লাটপাট হয়ে গেছে। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকার অনেকেই বাড়ি তৈরী করেছে। অবহেলা আর অযত্নে ধ্বংসের দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে চলছে মদ, জুয়া আর গাঁজার আড্ডা। সেই সঙ্গে প্রচলিত হয়ে উঠেছে ইয়াবা, হেরোইন, নেশাজাত ইনজেশন আর রাতের আঁধারে নারী দেহ ব্যবসা। স্থানীয়দের মতে এই রাজবাড়ি এখন হয়ে উঠেছে অসামাজিক কার্যকলাপের উন্মুক্ত কেন্দ্রবিন্দু। এগুলো যেন দেখার মত কেউ নেই। বর্তমানে প্রয়োজন এই ঐতিহাসিক রাজবাড়িটির সংস্কার। এটি সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাসের সাক্ষী এই দুবলহাটি রাজবাড়িটি সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য দর্শণীয় করে তোলার জন্য দাবী করেছে এলাকাবাসী।
×