ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে অতীতে অনেক কিছুই হয়েছে

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে অতীতে অনেক কিছুই হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, যতক্ষণ শ্বাস আছে ততদিন দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে যাব। দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং জনগণের ভোটের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতে জনগণের ভোটের মৌলিক অধিকার কেউ যাতে কেড়ে নিতে না পারে সেটাই আমরা চাই। জনগণের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত করে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে যাতে নিরপেক্ষ হয় সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভায় সূচনা বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইলেক্ট্রনিক ভোটিং সিস্টেমের (ই-ভোটিং) পক্ষে তার দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে আরও বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি দেশে ফিরে না এলে নির্বাচন হতো না, দেশে গণতন্ত্রও ফিরে আসত না। তাই আমরা সব সময়ই চাই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক; যাতে দেশের জনগণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজনের কথা পুনরুল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল বলেই আমরা দেশকে সবদিক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। সারা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন সম্মানজনক অবস্থানে উঠে এসেছে। সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে দেশে এত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, অনেক চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। এটাও বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য। ই-ভোটিং সিস্টেমের পক্ষে তার দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, অনেক দেশেই ই-ভোটিং সিস্টেমে ভোট হয়। আমরাও এ ব্যবস্থা চেয়েছি। কয়েকটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে ই-ভোটিং সিস্টেমে ভোটও হয়েছে। আগামীতে যাতে নির্বাচনে এ ব্যবস্থা হয় সে প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। সামরিক শাসন ও বিএনপির আমলে বিচারপতিদের নিয়ে নানা খেলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে অতীতে অনেক কিছুই হয়েছে। এমনও হয়েছে প্রধান বিচারপতি এজলাসে বসে আছেন, তাকে পত্রপাঠ বিদায় জানানো হয়েছে অথচ তিনি জানেনই না। আমরা দেখলাম একবার প্রধান বিচারপতির বয়স ৬২ থেকে ৬৫ আবার ৬৫ থেকে ৬২-তে আনা হলো। যিনি কেবলমাত্র অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, ভোট চুরির জন্য প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানানো হলো। চক্রান্ত করল যাতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়ে ভোট চুরির সুযোগ করে দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় যৌথসভাটি শুরু হয়। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরিচালনায় সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়াও ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস, ১০ নবেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসসহ কয়েকটি দিবসের দলীয় কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকে আগামী ১৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপে দলীয় প্রস্তাব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে তা চূড়ান্ত করা হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে সংবিধানের বাইরে কোনকিছু মেনে নেবে না আওয়ামী লীগ। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ক্ষমতা চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুধুমাত্র রুটিনওয়ার্ক পালন করবে, ইসির সঙ্গে সংলাপে তা জানিয়ে দেবে আওয়ামী লীগ। প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে এস কে সিনহার বিপরীতমুখী বক্তব্যের বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পায় এ যৌথসভায়। অসুস্থতা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে দরখাস্ত করে ছুটি নেয়ার পরও বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে নিজেকে সুস্থ বলে দাবি করায় বৈঠকে অনেক নেতাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার সূচনা বক্তব্যে ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শুরু হয় হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। উর্দি পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান শুরু করেন নির্বাচনের নামে প্রহসন। হ্যাঁ-না ভোট বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। তখন থেকেই মূলত নির্বাচনের নামে দেশে প্রহসন শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের পর এরশাদ সরকারের আমলেও একই প্রহসন চলে। তিনি বলেন, ’৯০ দশকে আন্দোলন করে আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনলেও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করায় দেশের জনগণ খালেদা জিয়াকে দেড় মাসও ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, সামরিক শাসনের সময় বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সংসদকে কুক্ষিগত করা হয়। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের সংসদে বসানো হয়, তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াই আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। বর্তমান সরকারের সময় অনেক নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অনেক জায়গায় বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এমনকি চারটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র হয়েছেন। জনগণ যাকে চেয়েছেন তাকেই ভোট দিয়েছেন। আমরা তো কোথাও বাধা দেইনি কিংবা ভোটের রেজাল্ট পাল্টাইনি। তিনি বলেন, আমরাই আন্দোলনের মাধ্যমে সেøাগাণ তুলেছিলাম- ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। মহাজোট গঠন করে আমরাই প্রথম নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবি জানিয়েছিলাম। তা পরবর্তীতে নিশ্চিত করা হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ করছে। আমরাও তাতে অংশ নেব। নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে। আমরা তা নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরব। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা যতজন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলাম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের মধ্যে প্রথমে ১০ জন বিচারপতিকে স্থায়ী না করে সরানো হয়। পরে আরও ছয়জনকে সরানো হয়। পরে অবশ্য কয়েকজন রিট করে ওই পদে ফিরে এসেছেন। নির্বাচনে কারচুপি করতে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো হয়, যদিও তিনি ওই দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার করা হয়। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার তার লড়াই-সংগ্রামের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ সৃষ্টির কারণে ফের ওয়ান-ইলেভেন আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতায় যারা আসেন তারা নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন। বিদেশে থাকাবস্থায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। অসুস্থ নাতি, ছেলের বউসহ সবাইকে ফেলে মামলা মোকাবেলার জন্য দেশে ফিরে আসতে চাইলে আমাকে বাধা দেয়া হয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার সংগ্রাম করেছি। ওই সময় দেশে ফিরলে আমাকে জীবননাশেরও হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু আমি মৃত্যুকে কখনও ভয় করি না। যতক্ষণ দেহে শ্বাস আছে ততক্ষণ গণতন্ত্রের জন্য কথা বলেই যাব। অনেকেই বলেছিল মামলা হলে অনেকে দেশ ছেড়ে পালায়। আমি বলেছি, আমি কখনও কোন অন্যায় করিনি, আমি পালাব কেন? আমি দেশে ফিরেই মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করব। অনেক বাধা ডিঙ্গিয়ে আমি দেশে ফিরে এলে বিনা ওয়ারেন্টে আমাকে গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। কোন সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই আমার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। তিনি বলেন, ওই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে না এলে দেশে নির্বাচনও হতো না, গণতন্ত্রও থাকত না। রাজনীতি নিজের জন্য নয়, রাজনীতি করিই জনগণের সেবা ও কল্যাণের জন্য। নির্বাচনে না এসে বিএনপি-জামায়াত জোটের জ্বালাও-পোড়াও ও ধ্বংসের রাজনীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। নিজে তাকে ফোন করেছি, বলেছি নির্বাচনে আসুন, সর্বদলীয় সরকার গঠন করি। এ সরকারে যে যে মন্ত্রণালয় চান সব আপনাকে দেব। কিন্তু উনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচনে না এসে তিনটি বছর ধরে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নাশকতা চালালেন। কিন্তু দেশের জনগণ তাদের সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই।
×