ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডিম দিবসে খামারবাড়িতে জনস্রোত ॥ ডিম না পেয়ে বিক্ষোভ, লাঠিচার্জ

তিন টাকা দরের ডিম নিয়ে লঙ্কাকান্ড

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

তিন টাকা দরের ডিম নিয়ে লঙ্কাকান্ড

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ৩ ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও ৩ টাকা দরে এক হালি ডিম কিনতে পারলেন না বলে আক্ষেপ করছিলেন ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা খাদিজা আক্তার। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ৩ টাকা পিস ডিম বিক্রির প্রচার দেখে অনেক খুশি হয়েই ডিম কিনতে এসেছিলাম। সকালে এসেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিম কিনতে পারলাম না। আয়োজকদের গাফিলতির কারণে আমার মতো হাজার হাজার ডিম ক্রেতা নাস্তানাবুদ হয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরল। এমন পরিস্থিতি মোটেও কাম্য নয়। রাজধানীর জিগাতলা থেকে খামারবাড়ি মোড়ে ডিম কিনতে এসেছিলেনন মারুফ হোসেন। তিনি বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এসেছিলাম। কিন্তু ডিম কিনতে পারিনি। বরং ভিড়ের মধ্যে পুলিশের ধাওয়ায় মাটিতে পড়ে গিয়েছি। আয়োজকরা কি মানুষজনকে অপদস্ত করতে এই আয়োজন করেছে? শুধু খাদিজা কিংবা মারুফ নন, বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে শুক্রবার রাজধানীর ফার্মগেটে খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে বাজারদরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম দামে ডিম কিনতে এসে অনেকেই খালি হাতে ঘরে ফিরেছেন। সে সঙ্গে অনেকেই আবার পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে ১২ টাকা হালিতে ডিম বিক্রির কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেতা এসে লাইনে দাঁড়াতে থাকেন। অবশ্য লোকমুখে শোনা গেল- কেউ কেউ নাকি রাত থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে! বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইন বাড়তে থাকে। সকাল ৭ টার সময়ই তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মূল গেট ছাড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। তখন ছিল অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশ। সময় যত গড়াচ্ছিল বেড়ে চলে মানুষের ভিড়। ৯ টার দিকে কেআইবির মূল প্রাঙ্গণে পা ফেলাও দায় হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয়, ১০টায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপস্থিতি। তখন লাইন ছাড়িয়ে যায় বিজয় সরণি পর্যন্ত। খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট যাওয়ার পথে তা ছড়িয়ে পড়ে পুলিশ বক্স পর্যন্ত। ৩ টাকা দরে জনপ্রতি ৯০টি করে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার ডিম বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন আয়োজকরা। তবে বিক্রির স্থানে অতিরিক্ত ভিড় হওয়ায় শত শত ডিম ভেঙ্গে যায়। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ডিম বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। বৃহস্পতিবার তিন টাকা দরে ডিম বিক্রির খবরের পরপরই জনকণ্ঠ অফিসে অসংখ্য ভোক্তা ফোন করে বলেন, এত সস্তায় ডিম বিক্রির কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কেননা, প্রকৃত ভোক্তারা ডিম পাবেন না। সেগুলো চলে যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে। ভোক্তাদের শঙ্কাই বাস্তবে সত্য হলো। শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও একযোগে উদযাপিত হয়েছে বিশ্ব ডিম দিবস। এ উপলক্ষে খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বিশেষ ছাড়ে ডিম বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। আয়োজক কমিটির সদস্য শ্যামলী পোল্ট্রি লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আজকে শুক্রবার আর বিক্রি হবে না। আমাদের ২০ হাজার ডিম বিক্রির টার্গেট ছিল। কিন্তু ভাবতে পারিনি এত লোক হবে। পরিস্থিতি মাথায় রেখেই ডিম বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ডিম না পেয়ে ক্রেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানান। ডিম দিবস উপলক্ষে সাজানো কেবিআই চত্বর নিমিষেই তছনছ হয়ে যায়। জনস্রোত সামাল দিতে না পেরে আয়োজক সদস্যরা ডিম সরিয়ে নিতে শুরু করেন। এবং ঠিক সে সময় উপচেপড়া জনগণ যে যার মতো ডিম সরিয়ে নেন। এদেরই একজন তামিম। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ডিম কিনতে না পারলেও ৬টি ডিম সরিয়ে নিতে পেরেছি। অন্যদিকে ২ ঘণ্টা অপেক্ষার পর হঠাৎ কেঁদে ফেলেন তামান্না হক। তিনি অনেকটা জোর করেই কেবিআইতে ঢুকে পড়েন। অবশেষে তিনি একজন আয়োজকের সহায়তায় প্রায় ৩০০ টি ডিম কিনে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন। যেখানে অনেকে এক হালি ডিম কিনতে পারেননি সেখানে ৩০০ ডিম একজন কিনেছেন এবং যা নিয়মবহির্ভূত। কারণ আয়োজক কর্র্তপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী কেউ ৯০ টির বেশি ডিম কিনতে পারবেন না বলে সতর্ক করা হয়েছিল। এসব অনৈতিক কর্মকা- দেখে মুহূর্তেই ক্রেতারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। এ সময় খামারবাড়ি চত্বরে স্লোগান ‘ডিম চাই ডিম চাই, ডিম চোরের ফাঁসি চাই’। আমাদের এমন হয়রানি করার কোন মানে হয় না। বিক্রির আগে কত ধরনের প্রচার চালানো হয়েছে। টিভি, পত্রিকা, ফেসবুকসহ মোবাইলেও বার্তা পাঠানো হয়েছে বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে ১২ টাকা হালিতে ডিম পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন একটি কা- হবে ভাবতেই পারিনি। ডিম বিক্রির নামে এসব নাটক, ভ-ামি ছাড়া কিছু নয়। ডিম কিনতে এসে এভাবে আয়োজকদের ওপর নিজের ক্ষোভ ঝাড়লেন আবুল কালাম। তার মতো হাজার মানুষকে ডিমের জন্য, চিৎকার-চেঁচামেচি, স্লোগান দিতে দেখা যায়। শুক্রবার খামারবাড়ি চত্বরে মহাখালী থেকে ডিমের খাঁচি নিয়ে ডিম কিনতে আসেন নাজমা আক্তার। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, সকালেই এসেছিলাম। কিন্তু একটি ডিমও কেনার সুযোগ পাইনি। ভিড়ের মধ্যে নিজের মোবাইলটি হারিয়েছি। এমন ব্যর্থ আয়োজনের জন্য আয়োজকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, ডিম দিবস উপলক্ষে আমরা সাধারণ মানুষকে একটি বার্তাই দিতে চেয়েছি, তা হলোÑ ডিম একটি পুষ্টিকর খাদ্য এবং সকলেরই ডিম খাওয়া দরকার। আমরা চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষ যেন কম দামে পরিবারের জন্য এক মাসের ডিম কিনে নিয়ে যেতে পারেন। সে জন্যই সর্বোচ্চ ৯০টি ডিম দেয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিশৃঙ্খলার কারণে সেটি আজ শুক্রবার সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের সিদ্ধান্তে আমরা বহাল আছি। পরবর্তীতে আলোচনাসাপেক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও বলেন, তবে এটাকে ব্যর্থতা বলব না, আমরা সফল। তিনি বলেন, আমরা যে রকম প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষের সাড়া পেয়েছি। তবে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য বিক্রি করা যায়নি। এজন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। এদিকে সকাল থেকেই ফেসবুকে ইস্যু হয়ে ওঠে ডিম দিবসের ব্যর্থ এই ডিম বিক্রির কার্যক্রম। আয়োজক ও ক্রেতা উভয়পক্ষকেই দোষারোপ চলেছে। ফেসবুকে সকালের দিকে লম্বা লাইন ও ভিড়ের ছবি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নানা ধরনের হাস্যরসাত্মক ছবি। সেসব ছবির ক্যাপশন সারা দিনই বিনোদনের খোড়াক যুগিয়েছে অনেককে। পক্ষে-বিপক্ষে চলেছে তর্কাতর্কিও। কেউ বলছেন ৩ টাকা মূল্যে ডিম কিনতেই এত লম্বা লাইন ধরতে হবে! আবার কেউ বলেছেন, আয়োজন সার্থক। আয়োজকরা হয়ত আলোচনায় আসতে চেয়েছিল। তারা সফলভাবেই তা করতে পেরেছে। ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে শুক্রবার সকাল ৯টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ডিমকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের প্রাণিজ আমিষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের সফলতার কথা উল্লেখ করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি বলেন- শিশুদের খর্বাকৃতি হওয়া এবং ওজন কমে যাওয়ার হার কমিয়ে আনা, পলিসি রিভিউ এবং নিউট্রিশন স্পেসিফিক ও নিউট্রিশন সেনসিটিভ ইন্টারভেনশন, সেফটি নেট প্রোগ্রাম চালু করাসহ যে সকল প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল তার বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যারা ডিম কম খাচ্ছেন তাদের বলব, পরিমাণ বাড়ান। আর সবাইকে বলব প্রতিদিন ডিম খান। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মাকসুদুল হাসান খান বলেন, সব বয়সী মানুষের জন্যই ডিম একটি দরকারি খাদ্য। তিনি বলেন, ডিমের মাথাপিছু কনজাম্পশন ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ মোঃ আইনুল হক বলেন, দেশের প্রতিটি পরিবারের পুষ্টি নিরাপত্তার লক্ষ্যে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালনকে উৎসাহিত করতে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দাম এবং পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই ডিমের চাহিদা বাড়ছে। তবে ২০২১ সালের চাহিদা পূরণ করতে হলে ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সব বিভাগীয় শহরে পোল্ট্রি শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। জেলা শহরগুলোতেও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহযোগিতায় ডিম দিবস পালিত হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও অনাথ শিশুর মাঝে এক লাখ ডিম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ঢাকায় এসওএস শিশুপল্লী, স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানা এবং ঢাকা অরফানেজ সোসাইটির শিশুদের জন্য বিনামূল্যে ডিম দেয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখ পোস্টার লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি ৫০ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর কাছে ডিম দিবসের বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার সকালে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে কৃষিবিদ প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়।
×