ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুগল পথচলা বাংলাদেশের

বাঙালী সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা, অন্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১২ অক্টোবর ২০১৭

বাঙালী সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা, অন্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি

মোরসালিন মিজান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরে দক্ষিণ কোরিয়ায় এমনকি ইংরেজীর কোন স্থান নেই। নাগরিকরা সবাই নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলেন। দেশটির সমাজ-সংস্কৃতি গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় সবখানে। বাংলাদেশের অভিবাসীরাও এই বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে প্রায় সকলেই কোরিয়ান ভাষায় কথা বলেন। অন্যের সংস্কৃতির প্রতি তাদের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। তবে হৃদয়ের গহীন কোণে কেবলই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নরম মাটিতেই যে নাড়ি পুঁতে রেখে গেছেন সবাই! স্বদেশ- সংস্কৃতির প্রতি তাই অপরিসীম ভালবাসা। গভীর অনুরাগ। বিদেশের মাটিতে শেকড়ের সংস্কৃতি তুলে ধরতে নিবিড় চর্চা অব্যাহত রেখেছেন প্রবাসীরা। কোরিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গেও তারা গড়ে তুলেছেন চমৎকার সেতুবন্ধ। দুটি দেশ যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশীর সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। এর কিছু কম-বেশিও হতে পারে। অধিকাংশই শ্রমিক। কলে-কারখানায় কাজ করেন। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। এর পরও সুযোগ পেলেই ঘটি-বাটি নিয়ে বসে পড়েন তারা। গান ধরেনÑ হইয়া আমি দেশান্তরী/ দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী, রে।/ নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে।/বন্দরে বন্দরে...। কোরাস কণ্ঠে সুর নেই। ভেতরটা তবু বেজে ওঠে। শুদ্ধ চর্চার দিক থেকেও দারুণ এগিয়ে বাঙালীরা। সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয় এমনকি কবিতার চর্চা বাঁচিয়ে রেখেছেন তারা। কেউ কেউ তো তারকাশিল্পী। গোটা কোরিয়া তাদের একনামে চেনে। এ আলোচনায় প্রথমেই আসে খানের নাম। বাংলাদেশের তরুণ। কিছুটা পরিবর্তন করে বাং দে হান নাম ধারণ করেছেন। কোরিয়ান নামের আগে যোগ করা ‘বাং’ মানে বাংলাদেশ! একেবারে বিমান বন্দর থেকেই নামটি শোনা যাচ্ছিল তার। বাঙালীরা আগ্রহ নিয়ে বলছিলেন, তাদের খান ভাই কোরিয়ার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছেন। স্থানীয় টেলিভিশনগুলোর তিনি প্রিয় মুখ। শিল্পীর সঙ্গে সহসাই দেখা হলেও, গান শোনার সুযোগ হয় অনেক পরে। সকলের অনুরোধে চলন্ত বাসে মাইক্রোফোন হাতে গান করেন তিনি। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...। শাহ আবদুল করিমের এই গান বার বার শোনা। এর পরও প্রবাসী শিল্পীর কণ্ঠ নতুনের মতো শোনায়। কী যে আবেগজড়ানো কণ্ঠে গাইলেন তিনি! পরে ছাংওউন শহরের একাধিক মঞ্চ ও ইওংজি কালাচারাল পার্কের বিশাল খোলা মাঠে শোনা হয় তাকে। শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন বাং দে হান। অবশ্য তিনি তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন কোরিয়ান ভাষার গান করে। তার গাওয়া ‘বিবিম বাপ’ গানটি দেশের প্রতি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। যে মঞ্চেই তিনি ওঠেন, এই গান না গেয়ে নামতে পারেন না! কোরিয়ান শ্রেতারা তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। নেচে গেয়ে অস্থির করে তোলেন চারপাশ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো আলাপ হয় শিল্পীর সঙ্গে। তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর আগে জীবিকার অন্বেষণে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। কোন কূল কিনারা হচ্ছিল না। এ অবস্থায় ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত মাম ফেস্টিভ্যালে গান করেন তিনি। কোরিয়ান ভাষার সঙ্গীত প্রতিযোগিতা। সবাইকে চমকে দিয়ে এ প্রতিযোগিতার সেরা শিল্পী নির্বাচিত হন তিনি। পরে গানের পাশাপাশি সিনেমায় অভিনয় করেন। এখন কোরিয়ায় বাংলাদেশের দূত হিসেবেই বিবেচনা করা হয় তাকে। সিনেমায় অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছেন মাহবুবও। জানা যায়, কোরিয়ায় নির্মিত একাধিক সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করাসহ বাঙালী সংস্কৃতি তুলে ধরতে কাজ করছেন মাহবুব। সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ইফতিও জনপ্রিয়। তার একটি অডিও এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে কোরিয়া থেকে। ভাল গান করেন সুমি। সব মহলে ব্যাপক পরিচিতি নেই কিন্তু অসাধারণ গান করেন, নাচ করেন এমন শিল্পী অনেক আছে কোরিয়ায়। তাদের বড় একটি অংশকে গত ১ অক্টোবর ছাংওউন কালচারাল ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে পাওয়া হয়। প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন সকলে। তার পর ভরপুর পরিবেশনা। একেবারেই ভিন্ন একটি পরিবেশে বসে প্রবাসী বাঙালী শিল্পীদের পরিবেশনা দেখে কী যে ভাললাগে! নৃত্য শিল্পী কথা স্থানীয়দের মাঝে মোটামুটি জনপ্রিয়। নাচের পাশাপাশি তিনি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার কাজ করেন বলে জানা যায়। পরিচিত মুখটি মঞ্চে আসে নৃত্য নিয়ে। সঙ্গে ছিল চৈতি ও হৃদি। দুজনের সবুজ শাড়ি। মাঝখানে ছিল লাল। এভাবে বাংলাদেশের পতাকার রংকে ধারণ করেন তারা। ব্যাকগ্রাউন্ডে কখনও লোকজ সুর, কখনও পাহাড়ী ছন্দ। কয়েকটি গানের চমৎকার কম্পোজিশন। সঙ্গে নাচ। ট্রাডিশনাল ড্যান্সের পাশাপাশি ফিউশন করার চেষ্টা করেন তারা। বাংলাদেশের মেয়েদের কোরিওগ্রাফি সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল না। তবে যেটুকু করে দেখান তারা, প্রশংসা করতে হয়। কোথা থেকে এই নাচ শেখা? বিদেশ বিভুঁইয়ে কে শেখাল এমন মুদ্রা? জানার কৌতূহল হচ্ছিল। পরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নেপথ্যের মানুষটির নাম রনি। প্রফেশনাল শিল্পী নাচ শেখান। শেষ গানের সঙ্গে নাচতেও দেখা যায় তাকে। সঙ্গীতের কথায় আবার আসা যাক, আশুতোষ অধিকারী নামের এক শিল্পী বেশ নজড় কাড়লেন। তিনি গাইছিলেনÑ চোর দিয়ে চোর ধরাধরি একি কারখানা/ আমি তাই জিজ্ঞাসিলে তুমি তো বল না...। গলা ছেড়ে গাওয়া গান শ্রোতাদের অধিকার করে নেয়। মুগ্ধ করে রাখে। নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলেন। একই শিল্পী সুন্দর দোতারা বাজান কুদ্দুছ বয়াতীর সঙ্গে। তামিম এখন কিশোর। লেখাপড়া নিয়ে আছে। সেই সঙ্গে চলছে সঙ্গীতের চর্চা। কোরিয়ার একটি গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে সে। মাম ফেস্টিভ্যালের মঞ্চেও বেশ জনপ্রিয়। সেদিন একটা গিটার হাতে গান করিছল। বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী মিনারের ‘ঝুম’ গানটি নিজের মতো করে গাইল। গেয়ে শোনাল কোরিয়ান একটি গানও। দুই ভাষার গানেই আশ্চর্য সাবলীল আগামীর তারকা! একই মঞ্চে তার ছোট ভাই তাজিন গাইল ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে’ গানটি। এই মায়ার এই পিরিতির কী মানে, সে হয়ত জানে না এখনও। তবে দিব্যি গাইল। পরে জানা গেল, তামিমের ভাই তাজিন। আরও চমকপ্রদ তথ্য এই যে, দুই কিশোর শিল্পীর পিতা জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা তিনি। বেশ বড় পোস্ট-পদবি। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত। বিদেশের মাটিতে নিজে সঙ্গীতের চর্চা করেন। তার সন্তানরাও শিখছে বাবার কাছ থেকে। জানা যায়, জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া বাঙালী সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন কোরিয়ায়। নাম বাংলাদেশ কালচারাল এ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের ব্যানারে নবীন-প্রবীণ অনেক শিল্পী সমবেত হয়েছেন। নিজেদের মতো করে বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, বোঝেন তো, বিদেশ। এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা। কাজ করেই শেষ করা যায় না। এর পরও মনের জোর ধরে রেখেছি। একসময় গাইতাম। এখন আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত করছি। বাংলাদেশের শিল্পীদের মতো শুদ্ধ চর্চা হচ্ছে কিনা জানি না। তবে প্রাণের খোদা মেটানোর চেষ্টা আমাদের আছে। সুন্দর এই ক্ষুধা, এই চেষ্টার জয় হোক।
×