ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাতলার বিল যেন এক শাপলার রাজ্য!

প্রকাশিত: ০০:১০, ১১ অক্টোবর ২০১৭

সাতলার বিল যেন এক শাপলার রাজ্য!

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ লাল শাপলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অহংকার। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই লাল শাপলার সমারোহ দেখতে কার না ভালো লাগে। কিন্ত এই ভালো লাগা-ভালোবাসায় পরিণত হলে আপনাকে বরিশালের মায়ার জড়াতে হবে। রুপসী বাংলার এই রুপের খোঁজে শহর ছাড়িয়ে উজিরপুর উপজেলার সাতলা নামকস্থানে প্রাকৃতিকভাবে শাপলার অবারিত রঙ্গিন রুপ আপনাকে শুধু মুগ্ধ নয় স্থম্ভিত করে দেবে। সাতলা বিলের ফুটন্ত শাপলা দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে সকালে। এ জায়গাটি ‘শাপলা বিল’ নামেই বেশি পরিচিত। চারপাশে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে এ যেন বাংলাদেশের এক “লাল স্বর্গ”। একসময় বর্ষাকলে সস্পূর্ণ ডুবে যেতো সাতলার বিল। স্বাধীনতার পর তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রথমে সাতলায় বাঁধ দেয়ার কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বিলের বিশাল এলাকা মনোরম এলাকায় পরিণত হয়। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবেই শাপলা ফোটে। সাধারণত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এই বিলে লাল শাপলা ফুল ফোটে। তখন নৌকা নিয়ে এই বিলে যাওয়া আরেক প্রাপ্তি। এ বিলে শুধু শাপলাই ফোটে না, শীতের মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন সব শাপলা মরে যায়। ওইসময় কৃষকরা এখানে ধান চাষ করেন। একইসাথে ধান ও শাপলার এই সহাবস্থান আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। সাতলার এ বিল তাই অনন্য। দূর থেকে সবুজের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র লাল ও সাদা বৃত্ত দেখে দুরূহ হয়ে উঠার মতো আসলে জিনিসগুলো কি? দূরত্ব কমার সাথে সাথে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফুলের অস্তিত্ব। আগাছা আর লতা পাতায় ভরা বিলের পানিতে সহস্র লাল ও সাদা শাপলা। সুর্য্যরে সোনালী আভা শাপলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এর সৌন্দর্য। বিলের লাল শাপলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে আপনা থেকে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনোমুগ্ধকর এ বিলের শাপলা দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন ভ্রমন পিপাসু প্রকৃতি প্রেমিরা। এ বিলের শাপলাকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে বিজ্ঞাপন চিত্র। ফলে দিন-দিন দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠছে ‘শাপলার বিল’। বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের উত্তর সাতলা, পাশ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এ বিল এখন স্থানীয়দের কাছে শাপলার বিল নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। বিলের মোট আয়তন সম্পর্কে জানা নেই স্থানীয়দের কারোরই। কেউ বলেছেন কয়েক শ’ হেক্টর, আবার কেউ দাবি করেন কয়েক হাজার বিঘা নিয়ে এ বিল। শাপলার বিলে ঠিক কতো বছর আগ থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে সে তথ্যও দিতে পারেননি কেউ। তবে আশপাশের গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, তাদের জন্মের পর থেকেই এ বিলে এভাবে শাপলা ফুটতে দেখছেন তারা। বছরের অধিকাংশ সময় জলমগ্ন এ বিলে লাল, সাদা ও বেগুনি রংয়ের তিন ধরনের শাপলা জন্মালেও লাল শাপলার আধিক্য বেশি। বিলের যতো ভেতরে এগুতে যাবেন ততোই লালের আধিক্য। একসময় মনে হবে শাপলার রাজ্যে বন্দি হয়ে আছেন আপনি। আশপাশ দিয়েই একটু পরপরই শাপলা গাছ ও আগাছা ঠেলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এদের অনেকেই বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছেন নৌকায়। এ বিলের শাপলা তুলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ওইসব এলাকার অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্থানীয়রা জানান, বাজারে সাদা শাপলার কদর বেশি। লাল শাপলার কদর থাকলেও এটি রান্না করতে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয়। লাল শাপলা সরাসরি রান্না করার পরেও কিছুটা কালচে রং থাকে। তাই রান্নার আগে এটিকে সিদ্ধ করে নিতে হয়। বিল সংলগ্ন গ্রামের একাধিক ব্যক্তিরা বলেন, বছরের ছয় মাস তারা অনেকেই এই বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন ওই এলাকার কয়েক শ’ পরিবার। এদের কেউ শাপলা তুলে, কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করেন। বিল সংলগ্ন পশ্চিম খাজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা রমেশ ঘরামী ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে প্রতিদিনই বিলের পানিতে মাছ শিকার করেন। শাপলার বিল হওয়ায় এখানে খাদ্যের বেশ যোগান থাকায় দেশী প্রজাতির মাছও ধরা পড়ে প্রচুর। দক্ষিণ বাগধা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর জব্বার জানান, তিনি মূলত অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। তবে বছরের ছয়মাস এ বিলে পানি থাকায় চাষাবাদের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পরে। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ জানান, সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এরমধ্যে সাদা, বেগুনী (হুন্দি শাপলা) ও অন্যটি লাল রংয়ের। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধী কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-শবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি। তিনি আরও বলেন, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনারী সমস্যার সমাধানসহ নারীদের ঋতু স্রাব নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে। তিনি আরও জানান, প্রতি একশ’ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, এ্যাশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্য প্রাণ ১৪২ কিলো, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাই মেটার ৮.৪, ক্রুড আমিষ ১৬.৮, ক্রুড ফ্যাট ২.৮, ক্রুড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ। যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। দীর্ঘকাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে থেকে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজা যায়। যা গ্রামগঞ্জে ঢ্যাপের খৈ হিসেবে পরিচিত। মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যাওয়ার পর শালুক তোলা হয়। যা খেতেও বেশ সু-স্বাদু। তবে আমাশয়ের জন্য এটি খুবই উপকারী।
×