ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অব্যবস্থাপনাসহ নানা সঙ্কটের চিত্র মাউশির রিপোর্টে

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পাঠদান চলছে জোড়াতালি দিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পাঠদান চলছে জোড়াতালি দিয়ে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সফল বলে কর্মকর্তারা সব সময় দাবি করলেও সরকারী পরিদর্শন প্রতিবেদনেই বেরিয়ে এলো অব্যবস্থাপনাসহ নানা সঙ্কটের চিত্র। মাধ্যমিক পর্যায়ের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পাঠদান পদ্ধতি চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে। বেশির ভাগ শিক্ষক ডিজিটাল পাঠদানে কনটেন্ট তৈরিতে আগ্রহই দেখাচ্ছেন না। এক শ্রেণীর শিক্ষক রয়েছেন যারা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিতেও আগ্রহী নন। কারণ তারা আইসিটি শিক্ষাসামগ্রী পরিচালনায় অদক্ষ। আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকও নেই অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মফস্বলের স্কুলগুলোতে ইন্টারনেট ও লোডশেডিং সমস্যাও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সফলতার পথে একটি বড় বাধা। সরকারী এ উদ্যোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ছয় পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে এমন নানা সমস্যার কথা। পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চললেও অনেক ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে অব্যবস্থাপনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের স্বল্পতা, মফস্বলের প্রান্তিক স্কুলগুলোতে ধীরগতির ইন্টারনেট, লোডশেডিং, ভৌত অবকাঠামো, জনবল সঙ্কট এবং পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষের অভাবের কারণে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে নামকাওয়াস্তে চলছে গুরুত্বপূর্ণ ‘আইসিটি ফর এডুকেশন ইন সেকেন্ডারি এ্যান্ড হায়ার সেকেন্ডারি লেভেল প্রজেক্ট’ নামের এ উদ্যোগ। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)। প্রকল্পটি মনিটরিং ও তদারকি করছে মাউশির একটি ইউনিট। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এর মাধ্যমে সারাদেশের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ডিজিটাল ক্লাসরুম’ চালু করে সরকার। প্রকল্পের অধীনে প্রতি বিদ্যালয়ে একটি করে ল্যাপটপ, স্পীকার, ইন্টারনেট মডেম, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, স্ক্রিন সরবরাহ করা হয়। যাতে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি সমন্বয়ের লক্ষ্যে ২০১২ সালে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কনটেন্ট সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু সুষ্ঠু তদারকি আর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে আশানুরূপভাবে কার্যকর হয়নি ডিজিটাল ক্লাসরুম পাঠদান পদ্ধতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় শিক্ষকদের। ফলে প্রশিক্ষণের পর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ভালভাবে পাঠদান করতে পারেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কনটেন্ট তৈরিতে রয়েছে শিক্ষকদের অনাগ্রহ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে শিক্ষকদের পাঠদানে আগ্রহের ঘাটতি, আইসিটি সামগ্রী পরিচালনায় অদক্ষতা। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সংখ্যা অপ্রতুল। আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সমস্যা, বিশেষ করে ধীরগতি, লোডশেডিং, ভৌত অবকাঠামোগত ও ক্লাসরুম সঙ্কট, কনটেন্ট তৈরি ও মাল্টিমিডিয়ার ওপর দেয়া প্রশিক্ষণের মেয়াদ পর্যাপ্ত ছিল না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এটুআই প্রকল্প ছাড়াও মাউশির অধীন বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ল্যাপটপসহ বিভিন্ন মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলছিলেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও কার্যকর করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং ও টেকসই করতে ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশের সকল আঞ্চলিক উপ-পরিচালক, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে। তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেটের ধীরগতি, লোডশেডিং বা সোলার প্যানেল নষ্টসহ কিছু বাস্তব সমস্যা দেখেছি মাঠপর্যায়ের স্কুলে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের বিষয়টিতে হয়তো আশানুরূপ ফল আমরা পাচ্ছি না। অনেক কিছুই রাতারাতি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে আমরা সুফল পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। সরকারীভাবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর কনটেন্ট তৈরিতে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করা হচ্ছে। পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাউশির কর্মকর্তারা প্রায় সকলেই বলছেন, প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সংখ্যা অপ্রতুল। আইসিটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। মাউশির মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন শাখার উপ-পরিচালক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার বলছিলেন, হ্যাঁ কিছু সমস্যাত আছেই। প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি মাত্র ক্লাসরুমে এ ব্যবস্থা থাকায় সকলের জন্য এ সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা একটি বড় সমস্যা। এছাড়া আরও কিছু সমস্যা আছে। তবে সফলতাও আছে। সমস্যাগুলো উত্তরণ করতে পারলে অনেক বড় একটা কাজ হবে। মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাসরুম সক্রিয় হচ্ছে কিনা বা পাঠদান হচ্ছে কিনা- তা মনিটরিং করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে অনলাইনে ড্যাসবোর্ডের মাধ্যমে তথ্যগ্রহণ করা হয়। প্রতিদিন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটি ডিজিটাল পদ্ধতির পাঠদান করে তার তথ্য প্রতিষ্ঠান প্রধানকেই (ড্যাসবোর্ডে) আপলোড করতে হয়। সে তথ্য থানা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের শিক্ষা অফিস পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ার মধ্যে জোড়াতালি আর ফাঁকিবাজির দিক প্রবল বলেই বলছেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও ড্যাসবোর্ডের তথ্য আপলোড করেন। তাই মাল্টিমিডিয়ায় পাঠদান পদ্ধতি যতটা কার্যকর হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অলস পড়ে আছে সরবরাহ করা ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, ইন্টারনেট মডেম। আবার কোথাও ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে এসব মূল্যবান উপকরণ। তথ্যপ্রযুক্তি সামগ্রী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার বা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে-বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বা বস্তাবন্দী করে রাখার মতো ঘটনাও আছে। অনেকে ক্লাস না নিয়েও ড্যাসবোর্ডে ক্লাস নেয়ার মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তারা এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা পেয়েছেন। এদিকে মাঠপর্যায়ের শিক্ষকরাই বলছেন সরকারের এ উদ্যোগে বাধা আসলে কোথায়? ভোলার বোরহানউদ্দিন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহব্বত হোসেন বলেন, প্রধান সমস্যা শিক্ষকরা কনটেন্ট তৈরি করতে চায় না। আমার স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক কোনরকম ক্লাস নেন। বাকি শিক্ষকরা একবারেই অনীহা দেখায়। কম্পিউটার শিক্ষক ছাড়া অন্য কোন শিক্ষক মাল্টিমিডিয়ার পাঠদানের প্রশিক্ষণ পায়নি। কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে দু’একটি ক্লাস নেয়া হয়, তাও জোরপূর্বক। রাজধানীর বুয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ আশুতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শিক্ষক ডিজিটাল পাঠদান ও কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। বাকিরা শিখে নিয়েছেন। বুয়েটের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আমরা হয়তো ফাঁকি দিতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ৪০ মিনিটের একটি ক্লাসের জন্য কনটেন্ট তৈরিতে দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যায়। এটা যেমনি শ্রমসাধ্য, তেমনি অধ্যয়নেরও বটে। এ কারণে শিক্ষকদের অনেকেই ডিজিটাল পাঠদানের চেয়ে কোচিং-টিউশনিতে বেশি আগ্রহী।
×