ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাস্তা নিজেই ছুটছে, উঠে বসলেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাস্তা নিজেই ছুটছে, উঠে বসলেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ মূল রাস্তার দু’পাশে ফুটপাথের ঠিক ১০ থেকে ১২ ফুট উপরে নির্মিত হবে চলন্ত রাস্তা। ১২ ফুটের ওই রাস্তা নির্মাণে নির্দিষ্ট অন্তর দূরত্বে নির্মিত হবে পিলার। পিলারের উপরে ইট সিমেন্ট বা স্টিলের অবকাঠামোকে ভিত্তি করে তার উপর নির্মিত হবে রেললাইনের পাটাতন। আর রেললাইনের উপরে বসবে অনেকটা ট্রেনের বগির মতো সিটযুক্ত রাস্তা। অনেকটা বগি আকৃতির চলন্ত রাস্তার নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকবে মোটর। আর তা ঘূর্ণায়মানভাবে ঘূর্ণনের জন্য সংযোগ থাকবে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থারও। ফুটপাথে স্থাপিত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে চলন্ত রাস্তার কোন একটি সিটে চড়ে বসলেই যানজট এড়িয়ে যথাসময়ে পৌঁছা যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। চলন্ত রাস্তার এমনই এক অভিনব ধারণার মডেল প্রদর্শনী চলছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। যানজট থেকে পরিত্রাণ পেতে করণীয় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সাইয়ীদের মাথায় খেলে যায় নতুন এই ধারণা। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন ব্যতিক্রমী এই ধারণা প্রদানের পর এবার তিনি রাস্তার কার্যপ্রণালী তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘চলন্ত রাস্তার নতুন এই ধারণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। নীতি নির্ধারক ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে ইতিবাচক সাড়া।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে ৪০০ কিমি চলন্ত রাস্তা নির্মাণে ব্যয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট পাওয়া গেলে মাত্র ২ বছরেই এই রাস্তা নির্মাণ সম্ভব।’ জানালেন, ‘এই রাস্তা নির্মাণে বাইরের কোন কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন পড়বে না। দেশীয় যন্ত্রপাতি ও কারিগরি দক্ষতাতেই তা নির্মাণ সম্ভব।’ মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ভাস্কর্য গ্যালারিতে চলন্ত রাস্তার মডেল প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রদর্শনীর জন্য রাস্তার মডেল নির্মাণ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও কিছু কিছু কাজ চলছে। দর্শনার্থী সমাগমও কম। তবু আসছে অনেকেই। যারা আসছেন তাদের প্রায় সবাই নতুন এই ধারণা সম্পর্কে জানতে উন্মুখ। আর অনেকটা ব্যতিব্যস্ত চলন্ত রাস্তার ধারণা প্রদানকারী চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সাইয়ীদ। কথা বলছিলেন আগুন্তুক দর্শনার্থীদের সঙ্গে। জনকণ্ঠের সঙ্গেও দীর্ঘ কথা হয় তার। জানালেন কার্যপ্রণালী সম্পর্কে। কেন এই ধারণা এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু সাইয়ীদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করে যানজটের সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। তবে রাস্তার আকারের কারণে দেশে তা সম্ভব নয়। মেট্রোরেল দিয়ে কিছুটা সমাধান করা সম্ভব। তবে পুরোপুরি নয়। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিন নিজে যে সমস্যায় পড়ি, আশপাশের মানুষকে যে সমস্যায় পড়তে দেখি; উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে যানজটের এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশে দীর্ঘ সময় ভাবতে ভাবতেই মনে হয় এটি একটি সমাধান হতে পারে। তিনি বলেন, চলন্ত রাস্তার এই ধারণাটি অনেকটা ট্রাম বা ইলেক্ট্রিক ট্রেনের মতো। আর চলন্ত রাস্তাটিতে মূলত রেললাইনের ধারণাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ট্রেনে একটি মাত্র ইঞ্জিন থাকলেও এখানে একাধিক মোটর থাকবে। আর এখানে কোন ইঞ্জিন থাকবে না। একটা মোটর যতটুকু রাস্তাকে মুভ করাতে সক্ষম ঠিক ততটা অন্তর অন্তর মোটর বসানো হবে। আর বিদ্যুতের ব্যবহার তো আছেই। তিনি আরও বলেন, চলন্ত রাস্তার এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে নগরীর পরিবেশ দূষণ কমবে। একই সঙ্গে যানজটমুক্ত পরিবেশে সুনির্দিষ্ট সময়ে সাধারণ মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। জ্বালানি খরচ কমে যাওয়ায় পরিবহন খাতের সার্বিক ব্যয়ও কমবে বলেও দাবি তার। তার মতে, চলন্ত রাস্তা বাস্তবায়নে খরচ কম হবে এবং তা বাংলাদেশের কারিগরি দক্ষতাতেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। কথা বলে জানা গেল, অবস্থানগতভাবে চলন্ত রাস্তা নির্মাণ হবে ফুটপাথের উপরে। প্রস্থে এটি ১২ ফিট হলেও দেশের রাস্তাগুলোতে ফুটপাথ আছে ৬ ফিট করে। তবে এতে মূল রাস্তার কোন ক্ষতি হবে না। কারণ চলন্ত রাস্তাটি মূল রাস্তা থেকে ১২ ফিট উপরে অবস্থান করবে। এবং এই পরিমাণ উচ্চতায় রাস্তাটি অবস্থান করায় নিচ দিয়ে গাড়িও চলাচল করতে পারবে। এছাড়া ওই অংশটিকে পার্কিং হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। যুক্তি হিসেবে ধারণা প্রদানকারী আবু সাইয়ীদের বক্তব্য, ঢাকার ফুটপাথের বড় অংশটিই অব্যবহৃত থেকে যায়। অধিকাংশ ফুটপাথই বেদখল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, চলন্ত রাস্তায় উঠার জন্য ফুটপাথে সিঁড়ি নির্মাণ করা হবে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, এই সিঁড়ি নির্মাণে ফুটপাথে চলাচলকারী ব্যক্তিদের কোন সমস্যা হবে না। কেননা ফুটওভারব্রিজের সিঁড়িও ফুটপাথের উপরেই অবস্থান করছে। তার মতে, রাস্তাটির পুরো অবকাঠামো একই ছাতার নিচে অবস্থান করবে। রাস্তায় উঠার পর মানুষকে রোদ-বৃষ্টিও পোহাতে হবে না। কেননা রাস্তার উপরে থাকবে অনেকটা ছাদের মতো এক কাঠামো। আর একবার এই রাস্তায় উঠে পড়লে যে কোন স্থানে যাওয়া যাবে। কেননা একটি রাস্তার সঙ্গে অন্যটি যুক্ত থাকবে। চলন্ত রাস্তাটি অনেকটা রেললাইনের মতো হলেও এটি পুরোপুরি ট্রেনের মতো নয়। অবকাঠামোতগভাবে সিট স্থাপনকারী রাস্তাটি বা বগিটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ থাকবে ঠিকই, তবে যাত্রী যেখানে বসবে তাকে সেই সিটেই বসে থাকতে হবে। আর সিট স্থাপনকারী বগির মতো কাঠামোগুলোর মাঝে মাঝে মোটর থাকবে, যা পুরো কাঠামোকে ঘূর্ণায়মান রাখবে। এটি হবে অনেকটা বৈদ্যুতিক। অর্থাৎ বিদ্যুত শক্তি ব্যবহার করেও চলবে এটি। ফ্লাইওভার বা ওভারব্রিজের স্থানগুলোতে কিভাবে চলন্ত রাস্তা নির্মাণ করা যাবেÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ফ্লাইওভার বা ওভারব্রিজের নিচ দিয়েই চলন্ত রাস্তা নির্মাণ করা যাবে। কারণ ফ্লাইওভারের পাশেই চলন্ত রাস্তা নির্মাণের মতো স্থান রয়েছে। তিনি বলেন, রাস্তার মাঝে বা পাশে যেখানেই চলন্ত রাস্তা স্থাপিত হোক না কেন, চলন্ত রাস্তা নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থামবে। একই গতির দিকে একাধিক লেন হলেও প্রতিটি লেনের চূড়ান্ত গতি একই থাকবে কিন্তু থামার সময় তা হবে ভিন্ন ভিন্ন। তিনি বলেন, ৩ লেনের চলন্ত রাস্তা হলে ১ম লেন ২ মিনিট পরপর ১০ সেকেন্ডের জন্য স্টপেজে দাঁড়িয়ে ফের চলতে শুরু করবে। একইভাবে অন্য লেনগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সময় নির্ধারণ করা থাকবে। তিনি আরও বলেন, চলন্ত রাস্তার জন্য ঢাকা শহরের চূড়ান্ত গতি হতে পারে ঘণ্টাপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ কিমি.। আর হাইওয়েতে তা হবে ৮০ থেকে ১২০ কিমি.। তার মতে চলন্ত রাস্তা ব্যবহার করে শহরে এবং হাইওয়েতে পণ্যও পরিবহন করা সম্ভব হবে। শুরু হওয়া এই মডেল প্রদর্শনী প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকছে। আর তা চলবে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
×