ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জেবা ও সোমা এসেছে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জেবা ও সোমা এসেছে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মুক্তামণির চিকিৎসা নিয়ে গণমাধ্যমে তুমুল আলোচনার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছে জেবা তাসনিয়া ও মোসকান আক্তার সোমা। তারা দুজনে দু’রকম রোগে আক্রান্ত। প্রায় দু’মাস আগে তারা ঢামেক হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের শিশু জেবা তাসনিয়া চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। ওর মুখের এক পাশ জন্ম থেকেই ফোলা ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ফোলাও বড় হচ্ছে। ফোলার জন্য এখন সারাক্ষণ এক চোখ প্রায় বন্ধ করে রাখতে হয়। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের আট বছর বয়সী মোসকান আক্তার সোমা অস্বাভাবিক একটি হাত নিয়ে জন্ম নিয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া সোমার হাতের মতো বুক ও শরীরের বিভিন্ন জায়গাও অদ্ভুতভাবে ফুলে যাচ্ছে। মুক্তামণি ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে জেনে আশায় বুক বাঁধছে এ দুই শিশু। তারা তাদের কষ্টগুলোকে খুব ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারে। শিশু সোমার সঙ্গে আছে তার দাদি। তার বাবা-মা থেকেও নেই। মা সোমা ও তার বারো বছরের বড় ভাইকে ছেড়ে অন্য জায়গায় সংসার পেতেছে। অন্যদিকে, তাদের প্রবাসী বাবাও ভিনদেশে সংসার পেতেছে। শিশু ওয়ার্ডে অন্যান্য শিশুর সঙ্গে আছে তাদের মা, আদর করছে, যতœ করছে। কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও মায়ের আদর পাওয়ার সৌভাগ্য নেই সোমার। বেশিরভাগ সময়ই প্রথম শ্রেণীর বই পড়ে সময় কাটায় সে। সোমা জনকণ্ঠকে বলে, ‘আমার সঙ্গে আমার দাদি আছে। বাবা-মা কেউ নেই পাশে, তাই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। কিন্তু দাদি আমাকে অনেক আদর করে। আমি ইচ্ছা হলে ঘুরে বেড়াই, বই পড়ি, আবার লিখিও।’ সোমার ডান হাত অস্বাভাবিকভাবে ফোলা। সে তার ডান হাতে তেমন শক্তিও পায় না। তাই ছোটবেলা থেকেই বাম হাতে লিখতে অভ্যস্ত সে। শিশু ওয়ার্ডে জেবার সঙ্গে আছে তার বাবা ও চাচি। অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত শিশু জেবা। সে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তিসহ ছবি আঁকাতেও পটু। জেবা জনকণ্ঠকে জানায়, চলতি বছর আবৃত্তিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের হাত থেকে সে এ পুরস্কার নিয়েছে। মন্ত্রী নিজে তার চিকিৎসার জন্য বার্ন ইউনিটে পাঠিয়েছেন বলে জানায় জেবা। বাবা-মা তাকে লেখার পাশাপাশি নাচ, গান শেখাতে অনেক শ্রম দেন। স্কুলে বান্ধবীদের অবজ্ঞাও জেবাকে কখনও হতাশ করেনি। সে বলল, স্কুলের অনেকেই আমাকে ‘হনুমান’ বলে ইনসাল্ট করত। এখন আর আমি এসব কথায় মাইন্ড করি না। কথাটি বলে হাসল সে। মুখের ফোলা অংশে ব্যথা করে কিনা- জানতে চাইলে সে বলল, ‘না, ব্যথা করে না। বাম চোখটি ফোলা থাকলেও দেখতে কোন অসুবিধা হয় না। তবে যখন বাম দিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকি তখন কানের পাশে ব্যথা করে।’ হাসপাতালারে বিছানায় শুয়ে সুস্থ হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে শিশু জেবা। তাসনিয়ার বাবা হাসান হাফিজুর রহমান কলেজের লাইব্রেরিয়ান আর মা নাসিমা খাতুন হাই স্কুলের শিক্ষক। তাসনিয়ার একমাত্র ভাইয়ের বয়স চার বছর। তাই তারা হাসপাতালে থাকতে পারে না। তাসনিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে থাকছেন তার চাচি নাজমা রহমান। তাসনিয়া মুখে অস্ত্রোপচার হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্তলাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, জেবার সমস্যাটি বিরল কোন রোগ নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘নিউরোফাইব্রোমা’ বলা হয়। কয়েক ধাপে অস্ত্রোপচার করতে হবে। তবে অস্ত্রোপচারের পরেও এ সমস্যা আবার দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। জেবার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন চিকিৎসকরা, সেই সঙ্গে চিকিৎসাও চলছে দ্রুতগতিতে। তবে এখনও জেবার অস্ত্রোপচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানালেন চিকিৎসক সামন্তলাল সেন। অন্যদিকে, রাজধানীর অন্য একটি হাসপাতালে পূর্বে সোমার বাম হাতে দুটি অস্ত্রোপচার করা হলেও তাতে সুস্থ হয়নি সে। কারণ আর্থিক সঙ্কটের কারণে গত চার বছর তার সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ ছিল। গণমাধ্যমে মুক্তামণির খবর শুনে বার্ন ইউনিটে গত দুই মাস আগে তাকে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানালেন সোমার দাদি হালিমা বেগম। বার্ন ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক লুৎফর কাদের লেনিনের অধীনে ভর্তি আছে সোমা। এই চিকিৎসক জনকণ্ঠকে জানালেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সোমার সমস্যাটিকে বলা হচ্ছে ‘ভাসকিউলার মেলফরমেশন’। সোমার হাতে অস্ত্রোপচার করা হলেও হাত দিয়ে সে তেমন কিছুই করতে পারবে না। তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাত ও আঙ্গুলগুলোর একটি আকৃতি দেয়ার চেষ্টা করা হবে। বুক ও ঘাড়ের টিউমারগুলোরও ধীরে ধীরে অস্ত্রোপচার হবে।
×