ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

দুর্গোৎসব হোক সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দুর্গোৎসব হোক সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন

নামের মাঝেই আছে দুর্গার মাহাত্ম্য। দ-শব্দটি দৈত্য নাশক। উ (ু) কার বিঘ্ন নাশক। রেফ (র্ ) রোগ নাশক। গণ্ডপাপ নাশক এবং আ-কার ভয় বা শত্রু নাশক। দৈত্য বা অসুর, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় এবং শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দেবী দুর্গা। শক্তি রূপে তিনি যেমন সকলের মাঝে এবং সব কিছুর মধ্যে বিদ্যমান, তেমনি তিনি সকল দেবগণের শক্তি, মিলন ও সমষ্টির মধ্যে প্রকাশিতা। দেবী দুর্গা মূলত স্বয়ং প্রকৃতি। দুর্গার মাঝে প্রস্ফুটিত হয়েছে সমস্ত প্রকৃতি। আবার প্রকৃতির একটি অংশ হচ্ছে-শস্য। ফসল ওঠার পূর্বে শরৎকালে দুর্গা তাঁর পুত্র-কন্যা নিয়ে স্বামীর গৃহ কৈলাশ থেকে পিতৃগৃহে আসেন। দুর্গার এই রূপটিতে বাঙালী হিন্দুর দৈনন্দিন জীবনের চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে। বছরের এ সময়টায় শস্য রোপণ শেষে কৃষক অবসর থাকেন। কৃষক মনের আনন্দ এবং গভীর ভাবাবেগে মাকে বরণ করে নিতে পারেন। তাই দুর্গাপূজা মানেই শস্যের আরাধনা। শস্যপূজার ধারার সঙ্গে পার্বতী-উমার ধারার মিলন ঘটেছে। দুর্গার আরেক নাম উমা। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীর সঙ্গে শস্যপূজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি হয়েছে। তিনিই দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা আবার অসুরনাশিনীও। দেবরাজ ইন্দ্রের বরে অসুররাজ মহিষাসুরের ধারণা হলো তাকে কোনও দেবতা বধ করতে পারবেন না; এই অহঙ্কারে মহিষাসুর দেবতাদের সতর্ক করে দেন, তিনি যে কোন মুহূর্তে স্বর্গ জয় করে নেবেন। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের শরণাপন্ন হন। দেবতারা ক্রোধান্বিত হয়ে তাদের পবিত্র দেহ থেকে স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছন্ন অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর জন্ম দেন। ইনিই দুর্গা। একেকজন দেবতা দেবী দুর্গাকে দিলেন একেক ধরনের অস্ত্র। এতে বলীয়ান হয়ে উঠলেন দেবী দুর্গা। যুদ্ধে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। এ ভাবেই দুর্গার রূপ বহুমুখী হয়েছে। একদিকে রয়েছে দেবীর কল্যাণরূপী, স্ত্রীরূপী ও মাধুর্যম-িত মাতৃরূপ অন্যদিকে আছে অসুরনাশিনী রূপ। অবশ্য যুদ্ধংদেহী অসুরনাশিনী দুর্গারূপে দেবীদুর্গাকে বাঙালী যতটা গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে দেবীর কোমল-স্নিগ্ধ মাতৃরূপকে বেশি গ্রহণ করেছে। বাস্তবে মনের অসুরকে পরাভূত করার মধ্যে দিয়েই দেবী দুর্গার প্রকৃত আরাধনা মাধুর্য মণ্ডিত হয়ে ওঠে। দুর্গার আরেক পরিচয়-তিনি শিবপত্নী। শিবই সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। শিব অনার্য দেবতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রমুখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে শিবের সর্বভারতীয় দেবতায় মর্যাদা লাভ যেন ভারতীয় অনার্য ভূমিপুত্রদের বিজয়েরই প্রতীক। শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে পার্বতী, উমা, গঙ্গা, দুর্গা ও কালীকে। শিবের পুত্র-গণেশ ও কার্তিক। কন্যা- সরস্বতী ও লক্ষ্মী। শিব ও দুর্গা। সুখতৃষ্ণার্ত মানুষের একান্ত মনের প্রতিচ্ছবি। এ রকম সুখী যুগল জীবন মানুষের জন্মজন্মান্তরের কামনা। প্রতিটি মানুষই কামনা করেন শিব-দুর্গার মতো দাম্পত্য জীবন। তাইতো যুগে যুগে দেবীদুর্গার পাশাপাশি শিবও পূজিত হয়ে এসেছেন। দেবীদুর্গার উৎপত্তি বেদ পরবর্তী যুগে। দুর্গার উল্লেখ রয়েছে নারায়ণ উপনিষদে- তৈত্তিরীয় আরণ্যকের পাতায়। ধর্মগুরুদের মতে দুর্গাপূজা বহুকাল আগ থেকে এ উপমহাদেশে প্রচলন রয়েছে। তবে ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে। প্রাক-আর্য সমাজে কৃষিজ উৎপাদনের উৎস রূপে। পরবর্তী আর্য সমাজে অম্বিকারূপী দুর্গাতে পরিণত হয়েছেন। দুর্গার সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী বর্ণনা পাওয়া যায়-মার্কন্ডেয় পুরাণ আর শ্রী শ্রী চণ্ডতে। চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে মার্কন্ডেয় চণ্ডী রচনার সময়েই মহাভারতের শেষভাগ রচিত হয়। মহাভারতে দুর্গা যশোদার কন্যা, কংসধ্বংসকারিণী, কুমারী ও মদমাংসপ্রিয়া। মহাভারতেই পাওয়া যায় অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের দুর্গার অরাধনা। তবে মহাভারতের এই পর্ব দ্বাদশ শতকে পুনর্লিখিত। ত্রয়োদশ আর চতুর্দশ শতকের দেবীপুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, বৃহন্নান্দিকেশ্বর পুরাণ ও দেবী ভাগবতসহ আরও কয়েকটি পুরাণে বিভিন্ন যজ্ঞের পরিবর্তে দুর্গাপূজার বিধান পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকে হিন্দুদের নবজাগরণের জন্য প-িত রঘুনন্দন দুর্গাপূজার একটি রূপরেখা তৈরি করেন ‘দুর্গাপুজা তরঙ্গিনী গ্রন্থে’। এ সময়ে পুরনো পুরাণগুলো আবার নতুন করে পরিবর্ধন আর পরিমার্জন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে যুক্ত হয় অকালবোধন। যে পূজা আমরা এখন করে থাকি। কৃত্তিবাসী রামায়ণে ব্রহ্মার নির্দেশে রাম শরতকালে দুর্গাপূজা করে রাবণ বধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ সময় থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন হতে শুরু করে। তবে ঐতিহাসিকভাবে তথ্য প্রমাণসহ দুর্গাপূজার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা রাজা কংসনারায়ণের সময়কার। পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে গৌড়ের রাজা কংসনারায়ণ সর্বপ্রথম মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। ওই আমলে প্রায় আট লাখ টাকা খরচ করে তিনি প্রথমবার শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। একই বছরে রাজশাহীর তাহিরপুরের আরেক রাজা জগতনারায়ণ প্রায় ন’ লাখ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এ আয়োজন ছিল তাদের বংশ মর্যাদা ও কৌলিন্য রক্ষার লড়াই। এরপর থেকে ধীরে ধীরে দুর্গাপূজার প্রচলন বাড়তে থাকে। তবে আঠারো-উনিশ শতক পর্যন্ত দুর্গাপূজা রাজা-জমিদারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গত শতকের বিশ-তিরিশ দশকের পরে দুর্গাপূজা সার্বজনীন রূপ নিতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর দুর্গাপূজা সার্বজনীনভাবে ব্যাপক আকারে শুরু হয়। দেশভাগের পর এককভাবে পূজা করা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সকলে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। যা এক পর্যায়ে বারোয়ারি পূজায় রূপ নেয়। আর বারোয়ারি মানেই তা অন্য রকম আনন্দ। এক কথায় দুর্গোৎসব। তবে এখনও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পারিবারিক পূজা চালু আছে। চলতি বছরে বাংলাদেশে ৩০ হাজারেরও বেশি ম-পে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। পূজার এ সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম এক অনুষঙ্গ। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পূজা। দেবীদুর্গার পূজা মানেই মায়ের পূজা। যা নিঃসন্দেহে মানুষকে মাতৃভক্ত হতে সহায়তা করে। তাই এ পূজা যেমন মাকে স্মরণ করে, তেমনি মানুষকে উদার করে তোলে। এবারের পূজায় আমাদের আরাধ্য হোক মাতৃভক্তি। দেশ মাতৃকার প্রতি সশ্রদ্ধ নিবেদন। যা দেশকালের গ-ি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়–ক গোটা বিশ্বে। মানুষে মানুষে গড়ে উঠুক সৌভ্রাতৃত্ববোধ। লেখক : সাংবাদিক
×