ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

বাবার ফেরার অপেক্ষায় পিতৃহারা অবোধ রোহিঙ্গা শিশুরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাবার ফেরার অপেক্ষায় পিতৃহারা অবোধ রোহিঙ্গা শিশুরা

রাজন ভট্টাচার্য, উখিয়া, কক্সবাজার থেকে ॥ ‘বাবার কাছে যাব। বাবা কোথায়। আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব আমি।’ এই বলে মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছিল পাঁচ বছরের শিশু মিনার। কোন ভাবেই তাকে শান্ত করতে পারছিলেন না মা আসিফা। মায়ের কোল থেকে বারবার নেমে যাচ্ছিল এই শিশুটি। টেকনাফের কাছাকাছি মিনা বাজারের রাস্তায় বাবার জন্য সন্তানের আর্তনাদ দেখে জড়ো হলো বহু মানুষ। কিন্তু বাবা তো নেই। তিনি এমন ঠিকানায় আছেন, কারও সাধ্য নেই তাকে সেখান থেকে ফেরানোর। কিন্তু নির্মম এই সত্যটি মিনার জানে না। অথচ প্রায় ১৫ দিন হতে চলল বাবা বেলালকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের মিলিটারিরা। প্রাণ বাঁচাতে মা আসিফা দুই সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। পিতৃহারা শিশুদের আর্তনাদ এখন টেকনাফ থেকে উখিয়ার পখে পথে। ক্যাম্প, রাস্তা, বাজার, পাহাড়, জঙ্গল সবখানেই স্বজনহারা মানুষের শোক। মিয়ানমারে নির্বিচারে গণহত্যা আর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশিরভাগ পরিবারে আছে স্বজন হারানোর কষ্ট। কেউ হারিয়েছেন স্বামী। কেউবা বাবা। হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন পুরুষরাই বেশি। বেশিরভাগ শিশুই জানে না তাদের বাবা আর কোনদিন ফিরবেন না। একেবারেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আসিফা জানালেন, তার স্বামী ছোট্ট ব্যবসা করতেন। এ দিয়েই তাদের সংসার চলত। বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল দোকান। তাই দিনের বেশ কিছু সময় মিনার বাবার সঙ্গে দোকানে থাকত। একদিন বাজারে যাওয়ার পথে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে আমার স্বামী মারা যান। তিনি একা নন সেদিন অন্তত ১০ জন গুলিতে নিহত হয়েছেন। পাশের গ্রামের রাস্তায় লাশ পড়েছিল। সকালে ঘটনা ঘটলেও আমি খবর পাই রাতে। কিন্তু পরিবারের হাতে লাশ দেয়া হয়নি। সব লাশ সেনাবাহিনী নিয়ে যায়। আমি চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে আসি। দিন দিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিকা- চলছেই। তিনি জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর আমার আর বাঁচার কোন ইচ্ছে ছিল না। কাকে নিয়ে বাঁচব আমি। কিন্তু আত্মীয়, প্রতিবেশীদের অনুরোধে এখানে আশ্রয় নেই। আমার দুই ছেলের মধ্যে মিনার বড়। ছোট ছেলের বয়স দেড় বছর। মিনার বাবার কথা বেশি বলে। রাতে বারবার ঘুম থেকে কেঁদে ওঠে। আমি বলি বাবা আসবেন। তোমার জন্য জামা কিনতে গেছে। কদিন দেরি হবে। আসার পথে অনেক কিছু নিয়ে আসবেন। কেনাকাটায় সময় যাচ্ছে। চিন্তা করো না। কিন্তু আর কতদিন মিথ্যা আশ্বাস দেব। এই বলে আসিফা ডুকরে কাঁদতে থাকেন। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এতিম শিশুর সংখ্যাও কম নয়। যাদের বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের বড় যারা ছিলেন সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেউ শুধু পিতৃ-মাতৃহারা। বাবাহারা অন্তত শতাধিক শিশু ও পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। টেকনাফ আর উখিয়ার পথে হোয়াইক্যং, মিনা বাজার, নীলা, কুতুপালং, বালুখালী, ঠেংখালী, বালংখালীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে এখন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ঠিকানা। বেশিরভাগ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ছোট-বড় পাহাড়ে। কুতুপাংয়ের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছিল ১০ বছরের শিশু ওমর। তার কোলে ছোট্ট বোন আয়েশা। ওর বয়স দুই। ওদের বাবা নেই। চোখের সামনে বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখেছে ওমর। জীবন বাঁচাতে মা দুই সন্তান রেখেই কোথায় গেছেন খোঁজ নেই। মায়ের জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষার পর ওমর বোনকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। এই দুই ভাইবোনের ঠিকানা এখন রাস্তা। বোনকে সড়কের পাশে রেখে ত্রাণ সংগ্রহ করে ওমর। মানুষের ভিড়ে হাতে ব্যথা পেয়েছে সে। ফুলে গেছে ডান হাতটি। তবুও বোনকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা ওমরের। ওমর জানাল, আয়েশা রাতে খুব কাঁদে। আমি ওকে শান্ত রাখতে পারি না। একটা ‘মা’ যদি পেতাম যিনি আমার মায়ের মতো করে আয়েশাকে দেখবে তাহলে আমি নিজেই তাদের দুইজনকে ত্রাণ সংগ্রহ করে খাওয়াতাম। কিন্তু এমন কেউ পাচ্ছি না। মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য আয়েশার চিৎকার আমাকে কষ্ট দেয়। সোমবার প্রতিবেশী এক মাকে বলেছিলাম আয়শাকে দুধ দিতে। দেননি। তিনি জানালেন, তার তিন সন্তানেই দুধের অভাবে দুর্বল হতে চলেছে। জানি না আমি আয়েশাকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখব। দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচায়। মঙ্গণাগুনা ও বালুখালীর রাস্তায় দেখা হয় রাশিদার সঙ্গে। বার্মার মংডুর বড্ডিল এলাকার বাসিন্দা তারা। তিন সন্তান রাশিদার। সবচেয়ে বড়টির বয়স চার। রাশিদার আক্ষেপ তাকে কেন হত্যা করা হয়নি। কারণ সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। প্রতি বাড়িতে নারীদের ধর্ষণ করে। আর পুরুষদের হত্যা করে। আমার স্বামীকে বাড়ির উঠানে ফেলে গলায় পাড়া দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘর থেকে দেখছিলাম এ বীভৎস দৃশ্য। আমার বড় ছেলেটিও বাবাকে হত্যার দৃশ্য দেখেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তিনি। পায়ে ধরেছেন নিষ্ঠুর সেনাদের। হাত জোর করে মিনতি করেছেন। বলেছেন, তোমরা আমাকে মের না, আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। যদি বল তবে এখনই যেতে প্রস্তুত। কিন্তু পাষ-দের মন গলেনি। তারা হত্যা ছাড়া কিছু বোঝে না। মৃত্যুর সময় ছেলে তালাশের নাম ধরে ডাকছিলেন তিনি। বলছিলেন, আমাকে বাঁচাও। বাঁচাও। দেখলাম আমার স্বামীর লাশ বস্তার ভরে পুকুরে ফেলে দিল ওরা। এরপর থেকে তালাশ আর কথা বলে না। পানি ছাড়া তেমন কিছুই খেতে চায় না। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। রাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে ও। ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এখানেও অস্ত্রসহ পুলিশ দেখলেও সে ভয় পায়। এখন ত্রাণের চেষ্টা করব, নাকি তালাশকে বাঁচাব এ কথা বলে কাঁদছিলেন রাশিদা। বলছেন, এমন বাস্তবতা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে ওরা যদি মেরে ফেলত তাহলে ভাল হতো। শান্তি পেতাম। হেলিকপ্টরের কথা শুনলেই কেঁদে ওঠে ছোট্ট শিশু আদিল। মংডুর তামিল গ্রামে বাড়ির উঠানে বসে বাবা কাজ করছিলেন। খুব কাছাকাছি হেলিকপ্টার থেকে আলী জোহারকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলো। দুই মিনিটের মধ্যে রক্তাক্ত আলীর দেহ নিথর। না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। ঘটনার সময় বাবার পাশেই ছিল আদিল। এই ঘটনা মনে দাগ কেটেছে তার। বয়স সাড়ে তিন বছর হলেও সে বোঝতে পারে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। কখনও কখনও সে সবকিছু ভুলে যায়। যেতে চায় বাবার কাছে। বাবার জন্য কাঁদে। অস্থির হয়ে ওঠে। মা লতিফা জানালেন, দিনভর রোদে দাঁড়িয়ে ত্রাণ এনে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি। কিন্তু তারা যা চায় তা তো ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য নেই। সবাই বাবা বলে অস্থির। তার কাছে যেতে চায়। তিনি বলেন, সন্তানদের কারণে আমাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আমিও মৃত্যু চাই। এমন জীবন আমি চাই না। ফুলমতি, রেহেলা, খুরশিদা, দিলবাহার এদের কারও স্বামী নেই। এরা প্রত্যেকেই জীবন নিয়ে যেমন সঙ্কটের মধ্যে আছেন তেমনি সন্তানদের বাবার কাছে যাওয়ার কঠিন আবদার জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রত্যেকেই জানালেন, তাদের সন্তানরা বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাবা আসবেন। খাবার আনবেন। বুকে জড়িয়ে আদর করবেন। ঘুম পাড়িয়ে দেবেন। বেড়াতে নেবেন। একসঙ্গে খাবেন। কিন্তু বিশ্বাসের পেছনের যে কঠিন সত্যিটি লুকিয়ে আছে তা অবুঝ শিশুদের কারও জানা নেই। রেহেলা জানান, আমার দুই শিশুর কেউ জানে না তাদের বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যখনই তাদের খাবার দেয়া হয় তখনই বায়না। বাবা আসলে খাব। বাবাকে ছাড়া খাব না। আমি বলি বাবা কাজে আছেন। সময় লাগবে আসতে। তোমরা খেয়ে নাও। কদিন পর বাবা আসবেন। তোমাদের জন্য অনেক কিছু কিনে আসবেন। ওরা কাঁদতে কাঁদতে খায়। এই বলে স্বামীহারা এই নারীর অঝোর কান্না। কে থামাবে রেহেলাদের কান্না। অবোধ শিশুদের বাবার অভাবই বা পূরণ হবে কিভাবে। হয়তো বাবার ফেরার অপেক্ষাতেই কাটবে নিষ্পাপ শিশুদের অনিশ্চিত সময়।
×