ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

রাজন ভট্টাচার্য, উখিয়া, কক্সবাজার থেকে ॥ কক্সবাজার শহর থেকে ৪০ কিলোমিটারের বেশি পথ উখিয়া। তারপরও অন্তত ১৫কিলোমিটার পেরিয়ে কুতুপালং। কুতুপালং বৌদ্ধ মন্দিরের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপর হিন্দু শরণার্থী শিবিরের একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। এতে লেখা রয়েছে, অসহায় হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল। অপ্রশস্ত কাঁচা পাহাড়ী পথ ধরে গ্রামের ভেতর দিয়ে কিছুদূর গেলেই চোখে পড়বে একটি মুরগির খামার। এখানেই ঠাঁই হয়েছে মিয়ানমার থেকে হত্যা আর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের। কাছাকাছি গেলেই শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। এখানে বেশিরভাগ শিশুই শূন্য থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। এদের অনেকের বাবা নেই। তাদের হত্যা করা হয়েছে। অনেক শিশুকে বাবার জন্য কাঁদতে দেখা গেছে। অবুঝ শিশুদের মুখে বার বার শোনা যাচ্ছিল ‘বাবা’ ডাক। অথচ তাদের বাবা নেই, তিনি আর কোনদিন ফিরবেন না। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। এর কোন কিছুই শিশুরা জানে না। তাদেরও অপেক্ষা বাবা আসবেন, বুকে আগলে রাখবেন। কোলে নেবেন। শোনাবেন ঘুম পাড়ানির গান...। শিবিরে পৌঁছার আগেই কানে আসে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ির কোলাহল। জানা গেল, ক্যাম্পটি স্থাপনের পর থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত তেমন কোন ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কুতুংপাল শরণার্থী শিবিরের কাছে হরি মন্দির লোকনাথ মন্দিরেও বেশ কিছু হিন্দু শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। সেখানকার চিত্রও একই রকম। জেলা প্রশাসন সূত্র ও কক্সবাজার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই তাদের পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। প্রথমে মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গেই বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল হিন্দুরা। তারপর স্থানীয় লোকজন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে হিন্দু রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়। এই শরণার্থী শিবিরে ১১৫টি পরিবারের সাড়ে ৫ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে শিবির চালাচ্ছেন স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রঞ্জিত দাশ রবিবার দুপুরে জনকণ্ঠকে জানান, ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১৭ হিন্দু রোহিন্দা এই ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এখন নতুন করেও কিছু যুক্ত হয়েছে। তিনি জানান, স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়, ব্যবসায়ী, পূজা উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় হিন্দু শরণার্থীদের খাবার দেয়া হচ্ছে। রঞ্জিত দাশ জানান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে পূজা পরিষদের পক্ষ থেকে হিন্দু শরণার্থীদের জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় পৃথক একটি ক্যাম্প করতে কয়েকটি জায়গার কথা প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন যেখানে তারা বাস করছে এর পাশেই শ্মশানঘাটের পেছনে বড় একটি জমি, যেখানে শরণার্থীরাও নিরাপদ মনে করছেন। এই জমিতেও ক্যাম্প হতে পারে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস আমরা পেয়েছি। হিন্দু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার আশ্বাসও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। এই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় নিবেদিতভাবে কাজ করছেন অনেকেই। তাদের একজন সুজন শর্মা। তিনি জানান, এই শরণার্থীদের জন্য যা কিছু ব্যয় হচ্ছে, তার কিছু অংশ কক্সবাজার পূজা উদ্যাপন পরিষদ বহন করছে। হিন্দু ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজনও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসে স্যানিটেশনের জন্য ৪১ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। সরকারী ত্রাণের কার্ড তারা হাতে পেয়েছে, কিন্তু ত্রাণ পায়নি। আমরা আশা করছি সরকারী ব্যবস্থাপনায় এই ক্যাম্পে ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করা হবে। ক্যাম্পের চিত্র ॥ মুরগির খামারটির অবস্থা রীতিমতো বেহাল। ভাঙ্গাচোরা অবস্থা। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। সারিবদ্ধ হয়ে খেতে বসেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এক মুঠো ভাত, অল্প পরিমাণ আলু ভর্তা ও একটুখানি ডাল। এটুকুই তাদের জন্য যথেষ্ট। কারণ সামান্য এই খাবার যোগানোর সাধ্য আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারও নেই। এখানে আশ্রিত শিশুদের বড় অংশের শরীরে কাপড় নেই। অনেক শিশু জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত। অনাহারে-অর্ধাহারে নিস্তেজ হতে চলেছে বেশ কয়েক শিশু। মায়ের পর্যাপ্ত খাবার নেই। তাই নবজাতকও দুধ পাচ্ছে না। মিলছে না শিশুর বিকল্প খাদ্যও। স্থানীয়রা জানান, ক্যাম্পের জন্য খামার থেকে মুরগি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ঢালাও বিছানায় গাদাগাদি করে রোহিঙ্গাদের বসবাস। থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে সাধারণ মানুষের সহযোগিতায়। নির্যাতনের চিত্র ॥ ক্যাম্পে অনেক নারী-পুরুষ জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু স্বামী হারানোর যন্ত্রণায় দিনরাত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অনেক নারীকে। ক্যাম্পে থাকা নারীর মধ্যে অনেকের স্বামীকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সন্ত্রাসীরা। নিজের চোখে স্বামীকে হত্যার দৃশ্য দেখেছেন এমন নারীও আছে এখানে। মৃতদেহ মিয়ানমারের রাখাইনে ফেলে এক কাপড়ে পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। এখন তাদের একেবারে খালি হাত। অর্থসম্পদ কিছুই আনতে পারেননি। কেউ যদি সহায়তা করে খাবার দেন তাহলেই বেঁচে থাকা। নইলে নিশ্চিত মৃত্যু। এই শিবিরের নারী-পুরুষের বক্তব্য হলো, তারা প্রত্যেকেই কৃপাপ্রার্থী। তারা এখন সন্তানদের নিয়ে শুধু প্রাণে বাঁচতে চান। তারা জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের যে হিন্দু গ্রামটি সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার সেটির নাম ফকিরাবাজার। ক্যাম্পে থাকা দেনাবালার বাড়ি ছিল এই গ্রামে। তিনি বলেন, অনেক দুঃখে সেখান থেকে তারা পালিয়ে এসেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাদের গুলি করেছে। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ভাত-পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। আমাদের মেরেছে-কেটেছে। মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই আমরা চলে এসেছি। এক গ্রাম থেকেই আমরা চার শ’ জনের মতো এসেছি। যারা মারতে এসেছিল, ওরা কালো পোশাক পরে এসেছিল। ওদের চিনি না। মুখোশ পরা ছিল। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছিল। বকুলবালা নামে আরেক শরণার্থী জানান, ফকিরাবাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চিকনছড়িতে তার বাড়ি ছিল। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম ফকিরাবাজারে। তার স্বামী মেয়েকে দেখার জন্য সেই গ্রামে যান। সেখানে তার স্বামী, মেয়ে এবং নাতি সবাইকে হত্যা করেছে। তিনি জানান, হত্যাকারীদের চিনতে পারিনি। ওরা কাটছিল, মারছিল, গুলি করছিল। সবাইকে মেরে ফেলেছে। ওরা কখনও বার্মিজ ভাষায় কথা বলছিল, কখনও বাংলা বলছিল। ওদের হাতে অনেক ধারালো অস্ত্র ছিল। চিকনছড়িতে যখন ওরা এসে পৌঁছায়, তার আগেই আমরা গ্রাম ছেড়ে পালাই। শিবকুমার নামে আরেকজন বলেন, তার মা-বাবা-খালা সবাইকে হামলাকারীরা মেরে ফেলেছে। হিন্দু-মুসলমান সবাইকে মেরেছে। গুলি করেছে। ওরা কালো পোশাক পরা ছিল। আমি চিনি না। চারদিক থেকে ঘেরাও করে আমাদের মারছে। হিন্দু-মুসলমান সবাই এক সঙ্গে পালিয়ে এসেছি। বকুলবালা জানান, স্বামী কানু রুদ্রর সঙ্গে তিনিও মাটির তৈজসপত্র বানাতেন। বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর চিকনছড়ি গ্রামে। পূজার আগে স্বামী-স্ত্রী মিলে হাঁড়ি, পাতিল, ঘট, পূজার ব্যবহার্য নানান জিনিস বানিয়ে শেষ করেছিলেন। কেনাবেচাও চলছিল বেশ। শুধু নিজেদের প্রস্তুতি বাকি ছিল। কথা ছিল বড় মেয়ে সন্ধ্যা বালা নাইয়র এলে মেয়ে, মেয়েজামাই আর একমাত্র নাতিকে নিয়ে কেনাকাটাটা করবেন। স্বামী কানু রুদ্র আগস্টের শেষদিকে ছোট মেয়ে সীতা বালাকে নিয়ে মেয়ের বাড়ি যান। তিনদিন পর তার ফেরার কথা। আর ফিরতে পারেননি। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি আসার সময় খুন হয়েছেন। বকুল বালা স্বামী, দুই কন্যা আর একমাত্র নাতিকে হারিয়েছেন। স্বজনের মৃতদেহ দেখারও সুযোগ হয়নি। তিন ছেলেকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এই ক্যাম্পে এখন আশ্রয় হয়েছে তার। ক্যাম্পে ভাল নেই নিতাই শীল, পরিমল শিল, বাদল, রাখালসহ অন্যরাও। নিতাইয়ের সারা শরীরে জখমের দাগ। চোখে রক্ত জমাট বাঁধা। চিকিৎসার দরকার। দেখার কেউ নেই। ব্যক্তি উদ্যোগে চলা শরণার্থী শিবিরের এই মানুষরাও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতোই অসহায়। মিয়ানমারে হিন্দু-মুসলিম একপাড়ায় ছিলেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে সদ্ভাব, সম্প্রীতি ছিল। মংডুর জন্য মন কাঁদে। বাংলাদেশে কী করবেন, ভবিষ্যত কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, এখনয় মিয়ানমারে ফিরে গেলে আমাদের ওরা মেরে ফেলবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরতে চাই না। বাংলাদেশ সরকার যেন মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করে এমন দাবি জানালেন অসহায় হিন্দু রোহিঙ্গারা। এক হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগ ॥ কক্সবাজারের উখিয়ায় এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ দুই সহোদর হিন্দু শরণার্থীর একজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। রবীন্দ্র পাল (৪২) নামে মিয়ানমার থেকে আগত এই ব্যক্তিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের শনিবার রাতে বলেন, পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী খাল থেকে সকালে রবীন্দ্র পালের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও মুখম-ল বিকৃত করা হয়েছে। স্বজনরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন বলে পূজা উদযাপন পরিষদ উখিয়া উপজেলা কমিটির সভাপতি স্বপন শর্মা রনি জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় আশ্রয় নেয়া কতিপয় রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর কাছে সেদেশে টাকা পাওনা ছিল রবীন্দ্র পালের। ওই টাকার জন্য এক সপ্তাহ আগে রবীন্দ্র পাল ও তার ভাই নীরেন্দ্র পালসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ১১ জন কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে যান। ওই টাকা নিয়ে কথার এক পর্যায়ে দেনাদার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীরা তাদের জিম্মি করে রাখে। এ সময় হিন্দু শরণার্থীদের মারধরসহ নানা নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে কৌশলে নয়জন পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও রবীন্দ্র পাল ও তার ভাই নীরেন্দ্র পাল নিখোঁজ ছিল। রবীন্দ্র পালের লাশ পাওয়া গেলেও নীরেন্দ্রর এখনও খোঁজ মেলেনি। আগে ধর্ষণ, তারপর ব্রাশফায়ার হঠাৎ খবর পেলাম পাশের গ্রাম ঘিরে ফেলেছে মিলিটারিরা। সেখানে নারীদের ওপর নির্মম নির্যাতন হচ্ছে। চলছে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। আর ঘরে বসে থাকতে পরিনি। গ্রামবাসীকে নিয়ে ছুটে গেলাম ছোটগজিল গ্রামে। দেখলাম পাশাপাশি কয়েকটি বাড়িতে পৃথক-পৃথকভাবে নারী ও পুরুষদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। গোটা গ্রামে মিলিটারিদের সশস্ত্র অবস্থান। ঘরের ভেতর থেকে নারীদের চিৎকারের শব্দ পাচ্ছিলাম। অনেকেই বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। অসহায় নারীদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস। আমরা প্রতিবাদ করলাম। সেনা বাহিনীর অফিসার আমাদের বোঝালেন, ওরা ভয়ে এরকম করছে। সন্ত্রাসী পুরুষদের পৃথক ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। সবাইকে ছেড়ে দেয়া হবে। আপনারা বাড়ি ফিরে যান। এই বলে সেনা অফিসার চলে গেলেন। আমরা তার কথা বিশ্বাস করিনি। আশপাশেই ছিলাম। নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে তা বোঝা যাচ্ছিল আহাজারির মাত্রা শুনে। নারীদের বাঁচাতে আমরা সেনাদের ওপর ইট পাটকেল মারতে থাকলাম। ওরা আমাদের গুলি শুরু করে। বৃষ্টির মতো গুলি আসছিল। ধাওয়া দেয়। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ঘরে আটকে রাখে। একটু পরেই চোখের সামনে সবগুলো ঘরে একসঙ্গে ব্রাশ ফায়ার করা হলো। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ছাই হলো প্রায় শতাধিক মানুষ। নিমিষেই নিভে গেল তরতাজা প্রাণ। মিয়ানমারের মংডুর চালিপরাং গ্রামের মহিউদ্দিন এভাবেই দেশটির সেনাবাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। নয় আগস্টের ঘটনা। যার পুরোটাই নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। কক্সবাজার থেকে মরিচ্যা, কুটবাজার, টিএনটি কলেজ, উখিয়া পাড়ি দিয়ে কুতুপালং। সেখান থেকে টেকনাফের পথ ধরে আরেকটু সামনে বালুখালী বাজার। এর আশপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। যারা মিয়ানমারে হত্যা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশের এসব ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। রবিবার বালুখালী বাজারে কথা হয় মহিউদ্দিনের সঙ্গে। যিনি বালুখালী ক্যাম্পের এ-১ ব্লকে একমাস ধরে বসবাস করছেন। তিনি জানালেন, সেনা বাহিনীর এরকম বর্বর হত্যার দৃশ্য দেখার পর থেকে চোখে ঘুম নেই। নির্যাতিত নারীদের কান্নার শব্দ কানে বাজে। বাঁচাও-বাঁচাও আর্তনাদ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। আমি কি করব। শত চেষ্টা করেও এই দৃশ্য ভুলতে পাচ্ছি না। জীবনে এমন ঘটনা কখনও দেখিনি। কারো কাছে শুনিনি। তাই চোখ থেকে কিছুতেই তা সরছে না। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ওপর পাথর ছোড়ার অপরাধে আমাদের ওরা গুলি করে। আমার ডান পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। আরেকটি পায়ে মারাত্মক আঘাত লাগে। মৃত লাশের মতো এ অবস্থায় নিজেকে বাঁচাতে মাটিতে শুয়ে ছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী চলে যায়। এরপর কোন রকমে বাড়িতে আসেন তিনি। কিন্তু তিনি যাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর গ্রামে ফেরেনি। কোনদিন ফিরবেও না। এখনও পায়ে ব্যান্ডেজ আছে মহিউদ্দিনের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তিনি জানান, বাড়ি ফেরার পর থেকে আশপাশে সোনার গজাবিল, বড়গজাবিল, চালিপরাং, জামুইল্যা, সিকদারপাড়া গ্রাম থেকে একই ধরনের হামলার খবর আসতে থাকে। আমি অস্থির হয়ে গেলাম। কি করব এখন। কয়েকদিন পর সকালে আমাদের গ্রামে সেনাবাহিনী আসে। আমাদের বলা হয়, বাঁচতে চাইলে দেশ ছাড়। তোমারা বাংলাদেশী। তোমাদের ঠিকানা সেখানে। তাই সেখানে যাও। এখানে তোমাদের ঠাঁই হবে না। কাল এসে যদি তোমাদের পাই কাউকে বাঁচতে দেয়া হবে না। পরদিন সকালে পাঁচ সন্তান, স্ত্রীসহ আমরা সাতজন বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেই। পথে পথে হাজারো বিড়ম্বনা ছিল। ১০ হাজার টাকা করে জনপ্রতি নৌকাভাড়া গুনতে হয়। মিয়ানমারের এক শ্রেণীর দালাল গোষ্ঠী সেখানে নৌকা বাণিজ্য করছে। কেন অত্যাচার করা হলো, এমন প্রশ্নে মহিউদ্দিন জানালেন মূল কথা আমরা তাদের দেশের মানুষ নই। তাই তাড়িয়ে দিতে হবে। বলেন, আমি কসমেটিক্সের ব্যবসা করতাম। ভালই ছিলাম। আয় উপার্জন ছিল বেশ। আমরা ব্যবসায়ী যারা ছিলাম তারা নিয়মিত সেনাদের টাকা দিতাম। তবুও বর্বরতা থেকে নিজেদের নিরাপদে রাখতে পারিনি। ঠেকাতে পারিনি গণহত্যা। অথচ সুচিকে ভোট দিয়েছি। ভোটের আগে বাঙালী হিসেবে ভোটারকার্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোটের পরদিন আমাদের থেকে সে কার্ডও ছিনিয়ে নেয়া হয়। কিভাবে এসেছেন বাংলাদেশে এর বর্ণনা দিতে গিয়ে মহিউদ্দিন বলেন, বাড়ি থেকে রওনা দেয়ার পর পথে সেনাবাহিনীর তা-ব দেখতে পাই। পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমাকে দেখলে ওরা মেরে ফেলবে। তাই পাহাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেই। অন্যপথে আমার স্ত্রীসহ সন্তানদের দূরে পাঠিয়ে দেই। টানা দিনদিন পাহাড়ে ছিলাম। জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কান্নার আওয়াজ পেয়েছি। নারীদের জঙ্গলে এনে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে সেনারা। মেয়ে আর মহিলাদের চিৎকার শুনতে শুনতে রাতভর কেঁদেছি। কিন্তু কোনকিছু করার উপায় ছিল না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসি। মোবাইলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে হয়। নীলা সীমান্ত হয়ে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। দেশে ফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, ফিরব। ব্যবসা আছে। কিন্তু সুচিকে ভোট দেয়ার পর পরই আমাদের জ্বালিয়ে দিল, হত্যা করল তা তো কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। মহিউদ্দিন জানান, আমাদেরসহ আশপাশের গ্রামে ১২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সবকিছু রেখে এক কাপড়ে চলে আসছি। নগদ টাকা ছাড়া আর কিছুই আনতে পারিনি। জানালেন, ক্যাম্পে কিছু ত্রাণ পাচ্ছেন। এ দিয়েই সংসার চলছে। কিন্তু বাচ্চাদের অবস্থা ভাল নয়। ওরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য খুব চিন্তা হয়। দুটি শিশু কয়েকদিন ধরে কথা বলছে না। কোথায় ডাক্তার দেখাব, কিভাবে ওদের সুস্থ করব কিছুই জানি না আমি।
×