ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গাছে গাছে ঝগড়া করে মূল্য বেশি কার!

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গাছে গাছে ঝগড়া করে মূল্য বেশি কার!

বছর কয়েক আগে জাতীয় বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উপলক্ষে সব গণমাধ্যমে বিশেষ করে টেলিভিশনগুলোয় একটি চমৎকার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। একদল বাউল শিল্পী এক মনোরম বৃক্ষকুঞ্জে নেচে-গেয়ে গাইত ‘গাছে গাছে ঝগড়া করে মূল্য বেশি কার...! মূলত বিভিন্ন বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, ঔষধি বৃক্ষসহ বিভিন্ন বৃক্ষরাজির উপকারিতা বর্ণনা করে রচিত এ সুখ-শ্রাব্য গানের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা, অনুপ্রাণিত করা। বাউলদের সে ছন্দময় গানে মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিল। বাংলাদেশে দিনে দিনে বৃক্ষরোপণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি অকারণে বৃক্ষ নিধনও অনেকটা কমে এসেছে। আজ অনেক বছর পরে আবার ওই গানের সুর ও কলিগুলো কর্ণকুহরে গুনগুন করছে। তবে এবারের বিষয় বৃক্ষরোপণ উৎসাহিতকরণ বা বৃক্ষনিধন নিরুৎসাহিতকরণ নয়। বরং এবারের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর যা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও এক ধরনের ভীতিমিশ্রিত আশঙ্কা-আতঙ্কের জন্ম দেয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি ও সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গের গত কিছু দিনের বাত-চিৎ এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ। প্রসঙ্গের সূচনা ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে। সরকার দলীয়দের অভিযোগ উচ্চ আদালত রায়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। জাতির পিতার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সংসদকে চরম অপমান করেছেন। এতে জনপ্রতিনিধিত্ব তত্ত্বের মারাত্মক মর্যাদাহানি ঘটেছে। প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে আমাদের মর্মমূলে কঠিন ও অনিরাময় আঘাত করেছেন। বিশেষ করে শোকের মাস আগস্টে- ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধানও তার সপক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা উক্তি করেছেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বেচারা আদালত কর্তৃক প্রতিনিয়তই ধমক খেয়েছেন। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের আদালতের বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-আস্থা সর্বোচ্চ। আদালতও বিভিন্ন সময়ে তার মর্যাদাকে কেবল অক্ষুণœই রাখেননি বরং তাকে আরও সুউচ্চতায় নিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে জনগণের মনের গভীরে লুকায়িত আবেগ-অনুভূতি-স্পৃহার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। দেশীয়-বিদেশীয় কোন চাপের কাছেই আমাদের মহামান্য আদালত নতি স্বীকার করেনি। বরং তাদের স্বাধীন সত্তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন যুগান্তকারী রায়ে। বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচারকরা আগের চেয়ে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। দ্রুত অগ্রসরগামী একটি সমাজ-রাষ্ট্রে অপরাধবৃত্তি থাকবে- কিন্তু বিবেচ্য হচ্ছে সেসব অপরাধের বিচার হয় কী না! গত ২২ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামিদের মৃত্যুদ- প্রদান প্রমাণ করে, এ দেশে ন্যায় বিচার আছে। মাত্র তিন বছরে এত বড় একটি সংঘবদ্ধ হত্যাকা-ের বিচার শেষে রায় প্রদান সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে বিলম্বে হলেও বিচার পাওয়া যায়। বিচারকার্য একটি কঠিন বিষয়। এক্ষেত্রে বিচারককে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে হয়। এ জন্যই এক সময়ে বিচারকদের চোখ বাঁধা থাকত-মাথায় পক্ককেশ টুপি পরতে হতো- যা বিজ্ঞতা, প্রবীণতা, ধীরস্থির ও আবেগ-শূন্যতার পরিচায়ক। বিচারকদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে মেলামেশা বারণ ছিল। তারা থাকতেন অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশে। সীমিত লোকজনের সঙ্গে তাদের মেলামেশা। ইসলাম ধর্মমতে পৃথিবীর প্রথম বিচারকার্যটি সম্পন্ন করেন, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং। গন্ধমবৃক্ষের ফল না খাওয়ার জন্য আদম-হাওয়ার প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ উপেক্ষিত হলে মহান আল্লাহ্ নিজ হাতে আদম-হাওয়াকে শাস্তি দেন- বিতাড়ন করেন বেহস্ত হতে। এটিই বিশ্বের প্রথম বিচারকর্ম ও প্রথম দ-। মুসলমানরা বিশ্বাস করে রোজ কিয়ামতের দিনে আল্লাহ্ পাক স্বয়ং আবার বিচারকের আসনে বসবেন এবং পুণ্যবান ও পাপীদের বিচার শেষে দ- প্রদান করবেন। তাই বিচার বিভাগ জন্মলগ্ন হতেই একটি আধ্যাত্মিক ও পবিত্র পরিম-লের আবহে তৈরি। বিচারকদের আসন/এজলাস সমতটে-সমতলে নয়- থাকে জমিনের ওপরে- কিছুটা উঁচুতে-উচ্চাসনে। এ ধরনের উচ্চাসন বা এজলাস আর একটি দফতরে আছে, তা হচ্ছে ভূমি নিবন্ধন কর্মকর্তা বা সাব-রেজিস্ট্রার/জেলা রেজিস্ট্রারের দপ্তর। ১৭৯৩ সালে যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়, তখন দেওয়ানী মামলার বিচারের ভার ছিলো সাব-রেজিস্ট্রারদের উপরে। সেই ১৭৯৩ সালে দেওয়ানী মামলায় তখনকার দিনে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা অর্থদ- প্রদানের ক্ষমতা ছিলো সাব-রেজিস্ট্রারদের। সেই কারণেই এখনো সাব-রেজিস্ট্রারদের অফিসকে এজলাস বলে। উঁচু আসন-লাল সালু দিয়ে ঘেরা বসার স্থান। বিচারকের দৃষ্টিতে সবাই সমান-উচ্চাসনে বসে সেটি অবলোকন করতে হয়। কোন আবেগ-অনুভূতি-রাগ-বিরাগ বিচারকের সাজে না। আমাদের বিচার বিভাগ তার প্রমাণ বহুবার দেখিয়েছে। কিন্ত গোল বেঁধেছে এবারের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে উদ্ধৃত কিছু সংলাপ-বাক্য-পর্যবেক্ষণ নিয়ে। যারা ষোড়শ সংশোধনী করেছেন তারা জনগণের প্রতিনিধি। আর জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। এক এক জনপ্রতিনিধি মানেই রাষ্ট্রের একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের আপামর জনতার প্রতিনিধি। রাজার প্রতিনিধি বা দূত যেমন রাজতুল্য সম্মান পায়, রাজার বার্তাবাহক যেমন বিশেষ মর্যাদা পায়- তেমনি গণতান্ত্রিক সমাজে জনপ্রতিনিধিরাও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বলে বিশেষ মর্যাদায় আসীন। হোক না তাদের কেউ ইয়াবা সম্রাট বা খুনের আসামি কিংবা নগদে তোলা তোলেন বলে নগদ চৌধুরী। তাতে কি? আখেরে তো তারা জনপ্রতিনিধি। জনগণ যদি দুষ্টু লোককে নির্বাচন করে তা হলে তো কারোরই কিছু বলার নেই। বরং এটুকু বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো যেন নির্বাচনে সৎ-ভদ্র, শিক্ষিত ও আইনসভার সদস্য হওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। বিজ্ঞ আদালত তাদের মতামত দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমজনতার কিছুই বলার নেই। আদালতই সর্বোচ্চ। কিন্তু আমাদের ভয় অন্যত্র। ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যরা একক দলীয় কর্তৃত্বের অধীনে থাকা সত্ত্বেও যখন তাদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না- যদি ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকত তা হলে কী এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হতো। যার কিছ্টুা নমুনা আমরা দেখেছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তামিলনাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আম্মাজান (জয়ললিতা)-এর মৃত্যুর পরে। বাংলাদেশের সংসদে এখন কোটিপতির সংখ্যা অনেক। ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকলে হয়ত কোন এক শুভ প্রভাতে দেখা যাবে- কোন এক কোটিপতি নেতা সংসদ ভবন হতে মাত্র ১ ঘণ্টার দূরত্বে বঙ্গভবনে গিয়ে হাজির। সঙ্গে সমর্থক সঙ্গী-সাথী। মহামান্য রাষ্ট্রপতি- এই দেখুন- এতজন সংসদ সদস্য আমার সঙ্গে আছেন। গদির মালিক আমি। আপনি অনুগ্রহ করে শপথ নেয়ার নির্দেশ দিন। এ অভিজ্ঞতা বাঙালীর আছে। তাই আমাদের আমজনতার ভয় সেখানেই। বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ রাষ্ট্রের অন্যতম দুটি স্তম্ভ। এ দুটি হচ্ছে- বিশাল বটবৃক্ষ বা মহীরুহ। বিচার বিভাগীয় বটবৃক্ষের ছায়াতলে ১৬ কোটি জনগণ ন্যায় বিচার প্রত্যাশী। অন্যদিকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ-সরকার আরেক মহীরুহ। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মূল নায়ক। এ দুটির মাঝে আমরা বিতর্ক দেখতে চাই না। দ্বন্দ্ব দেখতে চাই না। কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয়। সবাই সমান। সবাই মহামূল্যবান- মূল্য পরীক্ষার কোন সুযোগ এতে নেই। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ নামক তিনটি মহীরুহস্বরূপ স্তম্ভের ওপরেই টিকে থাকে একটি রাষ্ট্র। এর যে কোন একটি দুর্বল হলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি রাষ্ট্র সুপরিচালনার জন্য এ তিনটি স্তম্ভের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মান-সমন্বয় ও সহযোগিতামূলক সহাবস্থান অপরিহার্য। রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার জনগণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে। বাংলাদেশেও এ শাসন ব্যবস্থা চলমান। এমন কী রাজতন্ত্রেও রাজার কাছে প্রজারাই সর্বাধিক মূল্যবান। প্রজার সন্তোষই রাজার সন্তোষ। প্রজাকল্যাণই রাজার ধ্যান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। এখানে রাজা নেই, জনগণই রাজা। এটি জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের রক্তে কেনা একটি ভূখ-- একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে কৌটিল্য রাজ্যে বিচার বিভাগের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিটি বিবাদের সঙ্গে ধর্মের বিধিবিধান, শাস্ত্রের বিধান, দেশজ লোকাচার এবং রাজ্য শাসনের অনুশাসন সম্পৃক্ত থাকে। এ সবের মধ্যে রাজার অনুশাসনই চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে শিরোধার্য। এক্ষেত্রে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত থাকে সত্যে, ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত থাকে সাক্ষীদের মধ্যে, চরিত্র প্রতিষ্ঠিত দেশাচারের ওপর এবং শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে রাজাজ্ঞায়।’ বাংলাদেশের রাজা বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের আজ্ঞাতেই শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রের সব বিভাগ জনগণের আজ্ঞাতেই পরিচালিত হবে- এটিই সর্বোত্তম পথ। লেখক : সাবেক তথ্য কর্মকর্তা
×