ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিপাকে চাল মজুদদাররা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিপাকে চাল মজুদদাররা

তপন বিশ্বাস ॥ অবৈধ চাল মজুদদাররা বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন। সরকার জি টু জি পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত ৯ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন চলে এসেছে। বাকি ৭ লাখ টন চাল অক্টোবর ও নবেম্বরের মধ্যে দেশে আসছে। বেসরকারীভাবে ২৫ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। ১০ লাখ টন স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে ইতোমধ্যে দেশে ঢুকেছে। বাকি চাল দেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। আর দেশে ১৭ হাজার হাস্কিং মিল ও ৩ শতাধিক অটোরাইস মিল মজুদ থেকে চাল সরবরাহ করতে পারবে আরও চার মাস। তা ফুরানোর আগেই নবেম্বর-ডিসেম্বরে প্রায় সোয়া কোটি টন আমনের ফলন যোগ হবে। কোন সঙ্কট না থাকলেও বর্তমানে চালের বাজারে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পাইকারি বাজারে কেনা-বেচায় এসেছে মন্থরগতি। পরিস্থিতি না দেখে পাইকাররা এখন আরও সংগ্রহ বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ মজুদদাররা বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন। খাদ্য সচিব কায়কোবাদ হোসাইন বলেছেন, এ পর্যন্ত সরকার থেকে সরকার (জি টু জি) পদ্ধতিতে মোট ৯ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন চাল এসেছে। দেড় লাখ টন চাল আসছে (রাস্তায়)। বাকি সাড়ে ৫ লাখ টন চাল ১২ নবেম্বরের মধ্যে আসবে। জি টু জি পদ্ধতিতে আমদানি হলে দাম বেশি হয় কিন্তু আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে চাল আসলে দাম কম হয় কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অনেক সময় বিভিন্ন কোম্পানি চাল আমদানি করে দেয়ার চুক্তিভুক্ত হলেও পরে আমদানি করে না। তাই সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু জি টু জিতে চুক্তি হলে আমদানি কনফার্ম এবং অবশ্যই চালের মান ভাল হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেসরকারীভাবে ২৫ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে ১০ লাখ টন স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকেছে। বাকি চাল দেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। আর দেশে ১৭ হাজার হাস্কিং মিল ও ৩ শতাধিক অটোরাইস মিল মজুদ থেকে চাল সরবরাহ করতে পারবে আরও চার মাস। তা ফুরানোর আগেই নবেম্বর-ডিসেম্বরে প্রায় সোয়া কোটি টন আমনের ফলন যোগ হবে। সব মিলিয়ে দেশের কোথাও চালের কোন সঙ্কট নেই। টাকা নিয়ে বাজারে গেলেই কেনা যাচ্ছে চাহিদামতো। কিন্তু দাম রাখা হচ্ছে বেশি। সরকারও জি টু জি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করছে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের কাছ থেকে নতুন করে ৫ লাখ টন চাল কিনতে যাচ্ছে। ২৬ সেপ্টেম্বর এর দরপত্র ঠিক করা হবে। এরও আগে সরকার আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়ে চালের ২৮ শতাংশ শুল্কের মধ্যে ২৬ শতাংশই তুলে নেয়। নতুন সুবিধা হিসেবে সম্প্রতি যোগ করা হয় পাটের পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার, রেলপথে চাল আমদানি এবং স্থলবন্দর দিয়ে চালবাহী ট্রাক দ্রুত খালাসের নিশ্চয়তা। বিনিময়ে তিন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর (বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য) উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দেন- মিলগেটে চালের দাম ২-৩ টাকা কমানোর। তারা কমিয়েছেনও। আবার আমদানিকারকরা ৫ টাকা পর্যন্ত কমিয়েছেন দাম। কিন্তু চার দিন পার হয়ে গেলেও দাম কমার প্রভাব পড়েনি ভোক্তা পর্যায়ে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল এখনও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীতে পাইকারি বাজারগুলোয় চালের দামে মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে। যারা কম দামে আমদানি চাল তুলেছেন তারা পাইকারি পর্যায়ে ৪২ টাকায় মোটা চাল বিক্রি করতে পারছেন। কিন্তু ওই চাল খুচরা পর্যায়ে গেলেও তার দামে পরিবর্তন হচ্ছে না। আগের মজুদ না ফুরানোর অজুহাত তুলে খুচরা ব্যবসায়ীরা এখনও মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকাতেই বিক্রি করছেন। অথচ তা বিক্রি হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪৬ টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মিলারদের কাছে মোটা চাল নেই। যা আছে সেগুলো মাঝারি মানের। এ চাল মিলাররা ৪৮-৫০ টাকায় বিক্রি করলেও ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৭-৫৮ টাকা। আর মিনিকেটে মিলগেটে দাম কমানোর পরও তা ৬০ টাকার মধ্যেই ওঠানামা করছে। ভোক্তা পর্যায়ে এ চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬৩-৬৭ টাকার মধ্যে। এ প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি ঢুকে গেছে। ধরপাকড়ের ভয়ে চাল না ফুরালে নতুন করে আর চাল কিনতে চাইছে না। এ কারণে মিলগুলোতে বেচাবিক্রিও হচ্ছে না। তবে পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের মজুদেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আশা করছি, তারা সোম-মঙ্গলবারের মধ্যেই আবার মোকামমুখী হবেন। এর প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। এর জন্য চলতি সপ্তাহটা অপেক্ষা করতে হবে। নিরোধ চন্দ্র বলেন, তবে দাম ভোক্তা পর্যায়ে কতটা পড়বে সেটা নির্ভর করবে খুচরা বিক্রেতাদের মানসিকতার ওপর। এর জন্য স্থানীয়ভাবে বাজার নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যবসায়ীর দাবি, পাইকারি পর্যায়ে মোটা ৪০ ও সরু চাল ৫৮ টাকার নিচে নামার সুযোগ নেই। মিলারদের দাবি, সারা দেশে ১৭ হাজার হাস্কিং মিল রয়েছে। এদের যে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে প্রতিদিন উৎপাদনে গেলে তাদের ধানের মজুদ শেষ হতে বড়জোর এক মাস লাগবে। একইভাবে অটোরাইস মিলেরও যে মজুদ তা ফুরাতে লাগবে চার মাস। এ সময়ে আমনের ফলন ওঠার কথা থাকলেও কী পরিমাণ ফলন পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। তারা বলছেন, সরকারের পরিসংখ্যানে আস্থা নেই। তাই আমনের ফলন সোয়া কোটি টন দাবি করা হলেও সেটা কতটা বাস্তবভিত্তিক তা প্রশ্নসাপেক্ষ। রাজধানীর চালের সবচেয়ে বড় আড়ত বাবুবাজার, বাদামতলী ও কৃষি মার্কেটে দেখা গেছে, ক্রেতা স্বল্পতা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বেসরকারীভাবে আমদানি করা চালের দিকে এখন তারা ঝুঁকছেন। ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম কম। ফলে আগে বেনাপোল ও হিলিতে আমদানি করা যে চাল পাইকারি বাজারে ৪৭ টাকায় বিক্রি হতো কেজি, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়। এ কারণে স্থলবন্দর থেকে খালাসের পর চালভর্তি শতাধিক ট্রাক রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোয় পৌঁছেছে। পাইকাররা কম দামে ভালমানের চাল কিনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করছেন বলে জানান কয়েকজন। বাংলাদেশ রাইস মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও বাবুবাজার-বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাওসার আলম খান বলেন, রাজধানীর বৃহত্তম পাইকারি বাজারে এখন কাস্টমার নেই। বেচাকেনা শূন্য। কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুস সামাদ জানান, ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। মোকামে কেউ চাল কিনতে আসছেন না। মিলাররা চাল দু-এক টাকা কমে বেচতে চান, কিন্তু ক্রেতা নেই। আমদানিকারক সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন স্থলবন্দর দিয়ে শত শত টন চাল দেশে ঢুকছে। শুধু স্থলবন্দর দিয়েই আসছে না চাল। কলকাতা বন্দর দিয়ে মাদার ভেসল ও লাইটার ভেসেলে করেও নৌবন্দর দিয়ে দেশে চাল প্রবেশ করছে। প্রায় ৪ হাজার টন চাল নিয়ে চারটি মাদার ভেসেল বাংলাদেশের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার রওনা হয়েছে। এ চাল দুই-এক দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে প্রবেশ করবে। এছাড়া বিনা মার্জিনে চাল আমদানির সুযোগ থাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে চালের নতুন নতুন এলসি খোলা হচ্ছে। বর্তমানে ভারতে প্রতি টন চাল ৪২০-৪৬০ মার্কিন ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। দাম কমে আসায় চাল আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। বাবুবাজার মায়া ট্রেডার্সের ম্যানেজার রুস্তম আলী জানান, আগে সারাদিনে ৭০-১০০ বস্তা চাল বিক্রি হতো। এখন দাম নিয়ে অস্থিরতার কারণে বাজার ক্রেতাশূন্য। আমরা বেশি দামে কিনে তা কম দামে বিক্রি করতে পারি না। ফলে দিন শেষে এখন চাল বিক্রির পরিমাণ ৭-১০ বস্তায় দাঁড়িয়েছে। বিক্রি না হওয়ায় নতুন অর্ডারও দিতে পারছি না। তিনি দাবি করেন, দেশে চালের কোন সঙ্কট নেই। মিলারদের হাতে প্রচুর চাল রয়েছে। অন্তু সেন্টু রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মোঃ ইব্রাহিম খান বলেন, মিলারদের চালের দাম বেশি। এখন আমদানি চালের দামই তুলনামূলক কম।
×