ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চন্দনকৃষ্ণ পাল

মামার সাইকেল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মামার সাইকেল

বড় মামার মেজো ছেলে গৌতম। সিটে বসেও সাইকেল চালাতে পারে! এবার মামার বাড়িতে এসে আমি তো অবাক। খালি গৌতম না। পাশের বাড়ির সুধীর মামার ছেলে শ্রীবাস, জ্ঞানমামার ছেলে রিতেশও সাইকেল চালাতে পারে। তবে ও গৌতমের মতো সিটে বসে নয়। ত্রিকোণ রডগুলোর ভিতর দিয়ে পা ঢুকিয়ে চালায়। তবুও চালায় তো। দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। একমাত্র আমিই সাইকেল চালাতে পারি না। আসলে আমাদের বাড়িতে তো সাইকেল নেই। সাইকেল না থাকলে চালানোটা শিখব কিভাবে? বেশ ছোটবেলা সাইকেলের টায়ার চালিয়েছি। কাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিয়ে। তারপর সাইকেলের চাকা (রিং) চালিয়েছি। রিং এর দু’পাশ উঁচু থাকে। মধ্যে নিচু অংশে কাঠি বসিয়ে ঠেলা দিলেই চমৎকার এগোতে থাকে চাকা। এটা আমার খুব প্রিয় একটা বিষয় ছিল। সারা গ্রাম ঘুরতাম চাকা নিয়ে। পড়াশোনার চাইতে চাকার প্রতি যখন ভালবাসা বেশি হয়ে গেল তখন বাবার চোখে পড়ল বোধহয়। এক শুক্রবার সকালে চাকা নিয়ে বের হচ্ছি। বাবা আটকালেন। চোখ গরম করে বললেন- পড়াশোনা নেই? খালি চাকা আর চাকা। বলেই কাঠি এক ঝটকায় হাত থেকে নিয়ে সোজা পুকুরের মাঝখানে। কাঠিটা ভেসে রইল। কিন্তু চাকা মুহূর্তেই গভীর পানিতে তলিয়ে গেল। আমি পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চাকা পর্ব এখানেই শেষ। কিন্তু সাইকেল চালানো না শিখলে তো ইজ্জত সম্মান আর থাকছে না। শ্রীবাসকে বললাম- দোস্ত আমাকে শিখিয়ে দে। : গৌতমকে বল। বড় জেঠুর সাইকেল। শুক্রবার ছাড়া তো পাবি না। বড়মামা উপজেলা অফিসে চাকরি করেন। সাইকেলে চড়ে যাওয়া আসা করেন। শুক্র-শনিবার সাইকেল বাড়িতে থাকে। গৌতমকে পটালাম। বলল সামনের শুক্রবার দেখি কি করা যায়। আরও তিন দিন বাকি শুক্রবার আসার। আমার দিন কাটে না। শুক্রবার আসবে সাইকেল চালানো শিখব। রাতে ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখি। আমি নিজেই সাইকেল চালাচ্ছি সিটে বসে। রাস্তায় অন্য সাইকেল রিকশার পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছি সামনে। বেল বাজাচ্ছি তাও লোকজন রাস্তা থেকে সরছে না। কার যেন গায়ে লেগে গেলো সাইকেলের সামনের চাকা। বিরাট হৈ চৈ। আমি বলি- বেল বাজাচ্ছি সরেন না কেন? : এই কিসের বেল বাজাচ্ছিস রে। ওঠ আর কত ঘুমুবি? মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি লজ্জা পাই। স্বপ্নেও সাইকেল। আজ শুক্রবার। দুপুরের আগে সাইকেল বের করা যাবে না। শ্রীবাস আর রিতেশকে বলা আছে। ওরাও সাহায্য করবে। শুক্রবার দুপুরের খাবারের পর বড়মামা একটু দিবা নিদ্রা দেন। এটা মামার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। ঐ সময়টাই কাজে লাগাব আমরা। আমার সময় কাটছে না। মামার বাড়ি এসে নানান খেলায় মগ্ন থাকি আমরা। বড়ই গাছের একটা বড় ডাল পুকুরের পানির কাছাকাছি নেমে গেছে। সেই ডালে সবাই উঠে ঝাঁকি দিয়ে ডালটিকে পানির ভিতর নিয়ে যাই। আবার উপরে উঠে আসি। এ এক মজার খেলা। অথবা সুধীর জেঠুর খেজুর গাছ থেকে পাকা খেজুর চুরির ধান্দা করি। সেই চুরির সঙ্গে শ্রীবাসও যুক্ত থাকে। ওদের খেজুর গাছের খেজুর চুরি করছি ওকে সঙ্গে নিয়ে। কি কা-! কিন্তু আজ কোন কিছুতেই আমার মন বসছে না। অন্যদিন পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়। আজ ওরা সাঁতার কাটছে। আমার মাথায় সাইকেল। লাই খেলাও জমলো না আজ। ¯œান করে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরের টং ঘরে পাটি বিছিয়ে গড়াগড়ি করি আমি আর গৌতম। বড় মামা হাত মুখ ধুয়ে তার রুমে শুয়ে পড়লেই বারান্দা থেকে সাইকেল নিয়ে বের হবো আমরা। প্রথমে প্রাইমারী স্কুলের মাঠে শিখব। তারপর রাস্তায়। প্ল্যান রেডি। এখন শুধু অপেক্ষা। শুভক্ষণটি এসে যায়। গৌতম চুপি চুপি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর সোজা প্রাইমারী স্কুলের মাঠে। শ্রীবাস আর রিতেশও চলে এসেছে। আমাকে প্রথমে রডের ভিতরে পা ঢুকিয়ে চালাতে শেখায় গৌতম। আমি প্যাডেল চাপি ওরা ধরে রাখে। কিছুক্ষণ চলে। কিন্তু সব সময় ব্যালেন্স থাকে না। তখন পা একপা মাটিতে নামিয়ে দেই। এভাবে কয়েক চক্কর দেই মাঠে। সাইকেলটা বেশ ভারি। অন্য তিনজনের চাইতে আমি একটু লম্বা। রিতেশের প্রস্তাব এবার সিটে বসে চালা। আমার ভয় লাগে। গৌতম আমাদের মধ্যে খাটো। ওদের যুক্তি গৌতম খাটো হয়েও যদি সিটে বসে চালাতে পারে আমি পারব না কেন। তাই তো। ওরা সাইকেল ধরে রাখে। আমি সিটে বসে প্যাডেল চাপতে চেষ্টা করি। ওরা ধাক্কা দেয় আমি প্যাডেল চাপি। কয়েকবার পড়ে যাই। আবার চেষ্টা করি। এভাবে মোটামুটি ব্যালান্স রাখা সম্ভব হয়। এক নাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ চালাই। তবে পিছনে কেউ না কেউ ধরে ধরে সাইকেলের সঙ্গে হাঁটে। আমি সাহস পাই। : এবার রাস্তায়। বড় পুলের উপর থেকে শুরু করবি। যতটুকু যেতে পারিস। শ্রীবাস এর কথা শুনে ভয় পাই আমি। : পিছনে কেউ থাকবি তো? : অবশ্যই। তাও আমার ভয় কাটে না। কিন্তু ওদের চাপাচাপিতে রাজি হই। বড়পুল অনেক উঁচু। পুল থেকে রাস্তা ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমেছে। দুই পাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতে জমানো পানি। আমি পুলের একপ্রান্তে সাইকেলের সিটে বসি। যেহেতু প্যাডেল নাগালে আছে। ভয় কিসের। তারপর পেছনে শ্রীবাস গৌতম বা রিতেশ একজন তো থাকছেই। যাত্রা শুরু করি। পুলের অংশট্কুু পার হয়ে ঢালু অংশটুকু পার হয়ে ঢালু অংশে নামি। সোজা সামনে তাকাই। দ্রুত বেগে এগোচ্ছে সাইকেল। অর্ধেক মতো নেমে পিছন ফিরে তাকাই। আমার আত্মরাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায়। পিছনে কেউ নেই। তিনজনই পুলের ওপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। আমি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলি। সাইকেল চোখের পলকে সড়কের পাশের ধানক্ষেতে আমাকেসহ পড়ে যায়। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে যাই আমি। তিনজনই দৌড়ে এসে ধানক্ষেতে নামে। টেনে তুলে আমাকে। : ব্যথা পেয়েছিস? আমি ব্যথা পেয়েছি কি না বুঝি না। বুকের ভেতর ধুপধাপ আওয়াজ। কাদাপানি থেকে রাস্তায় উঠে আসি। কিছু হয়নি। কিছুই না। কাদা পানিই বাঁচিয়েছে। শুকনা জায়গায় পড়লে হাত পা ভেঙ্গে যেত। সব শ্রীবাসের ষড়যন্ত্র। শেষ মুহূর্র্তে ও রিতেশ আর গৌতমকে আটকে দেয়। আমিও গাধার মতো পিছনে তাকাই। পিছনে না তাকালে কিছুই হতো না। শ্রীবাসের ওপর ভীষণ রাগ হয় আমার। ওর পিঠে ভীষণ জোরে একটা কিল বসিয়ে দেই আমি। ব্যথায় বাঁকা হয়ে যায় শ্রীবাস। কিন্তু ওর মুখে হাসিটা লেগেই থাকে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×