ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীর ১৩৩ বছরের পুরনো গ্রন্থাগার ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাজশাহীর ১৩৩ বছরের পুরনো গ্রন্থাগার ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ আধুনিক কমপ্লেক্স তৈরির নামে এবার ১৩৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সাধারণ গ্রস্থাগারের মূল অবকাঠামোয় পড়তে যাচ্ছে কুঠারাঘাত। দীঘাপাতিয়ার জমিদার রাজা প্রমদানাথ রায়ের দান করা জমিতে কাশিমপুরের জমিদার রায় বাহাদুর কেদারনাথ প্রসন্ন লাহিড়ী স্থাপন করেছিলেন রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি। ১৮৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও গ্রন্থাগারটির সূচনা আরও আগে। রাজশাহী মহানগরীর মিয়াপাড়ায় অবস্থিত বলে এটিকে ‘মিয়াপাড়া সাধারণ গ্রন্থাগার’ বলেই চেনে অনেকে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রানী ভবানীর বংশধর রাজা আনন্দনাথ। যাত্রা শুরুর সময়টি ধরলে বর্তমানে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের বয়স ১৩৩ বছর। রাজশাহীর এ হেরিটেজটি এবার ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। শীঘ্রই এটি ভেঙ্গে সেখানে বহুতল কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেখানে কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হবে। এ নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, ঐতিহ্য ভেঙ্গে নয়, সেটিকে টিকিয়ে রেখেই বহুতল ভবন তৈরি সম্ভব। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ও সাধারণ গ্রন্থাগারের সভাপতি হেলাল মাহমুদ শরিফ জানান, গ্রন্থাগার ভবনটির অবস্থা ভাল নয়। সেটি ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য অর্থায়নও পাওয়া গেছে। তবে এটির যেহেতু ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সে কারণে তার একটি রেফ্লিকা তৈরি করা হবে, যাতে মানুষ জানতে পারে আগে গ্রন্থাগারটি কেমন ছিল। ঐতিহাসিকভাবে এ গ্রন্থাগারটি এ অঞ্চলের হেরিটেজ। ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এ গ্রন্থাগারটি। তবে এর আগে ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের স্ট্যাটিস্টিক্যাল এ্যাকাউন্ট বইয়ে এ গ্রন্থাগারের কথা বলা হয়েছে। ১৮৮৪ সালে ভবন এবং জমি পাওয়ার পর গ্রন্থাগারটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। হান্টারের বইয়ে থাকা তথ্যমতে, ১৮৭১-৭২ সালে গ্রন্থাগারটিতে বই ছিল মাত্র তিন হাজার ২৪৭টি এবং সাময়িকী ছিল ছয়টি। এ সময় পাঠক ছিলেন নয়জন। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন ইংরেজ। রাজা আনন্দ রায়ের পর তার ছেলে রাজা চন্দ্র রায় বছরে ২০ পাউন্ড বা ২০০ টাকা অনুদান দিতেন। এরমধ্যে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের কাশিমপুর হাউসে এক সময় ছিল এ গ্রন্থাগারটি। দীঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ রায়ের দান করা বর্তমান ভবনে মিয়াপাড়ায় গ্রন্থাগারটি স্থানান্তিরত হয়। তার চার ছেলে রাজা প্রমদনাথ রায়, কুমার বসন্ত কুমার রায়, কুমার শরৎ কুমার রায়, কুমার হেমন্ত কুমার রায় এবং মেয়ে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা রায় রাজশাহীর অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো এ গ্রন্থাগারটিতেও বিভিন্নভাবে সহায়তা দিতেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে জেলা প্রশাসন, রাজশাহী এ্যাসোসিয়েশন এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে নিয়মিত অনুদান পাওয়া যেত। এখন শুধু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বছরে অনুদান পাওয়া যায় ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বই হিসেবে দেয়া হয় ৩০ হাজার টাকা এবং নগদ অনুদান পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা। এখানকার শতকরা ৫০ ভাগ বই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ। গ্রন্থাগারের বয়স ১৩৩ বছর হলেও এখানে ২০০ বছরের পুরনো বইও আছে। স্কটল্যান্ড থেকে প্রকাশিত সেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলীর প্রথম সংস্করণ, এ্যানুয়াল রেজিস্টার, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই বলে সভ্যতা’র প্রথম সংস্করণ, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’র প্রথম সংস্করণ, ব্রিটিশ আমলের পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বসুমতি’, ‘রিভিউ’ প্রভৃতি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পত্রিকা থাকার কারণে বহু গবেষকের আগমন ঘটে এখানে। মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, নেতাজী সুভাষ বোস, ড. সুনিতি কুমার চট্টোপাধ্যায়সহ বহু গুণী মানুষের আগমন ঘটেছিল এ গ্রন্থাগারে। ফলে গ্রন্থাগারটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেয়ায় ক্ষুব্ধ রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীরা। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি ভেঙ্গে কমপ্লেক্স নির্মাণের বিরোধিতা শুরু করেছেন তারা। স্থানীয় কবি শামীম হোসেন মনে করেন, ‘এ ভবনটি ভেঙ্গে নতুন কমপ্লেক্স তৈরি হবে। আমি বরাবরই ঐতিহ্য রক্ষা করে উন্নয়নের পক্ষে। যদি নতুন কিছু করতেই হয় তবে মূল ভবন সংস্কার করে গ্রন্থাগারের পেছনে বিশাল জায়গা ফাঁকা আছে- বরং দৃষ্টিনন্দন করে সেখানেই তা তৈরি করা হোক। একটু অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে তাকালেই আমরা দেখতে পাব এর আগেও রাজশাহীর ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা ভেঙ্গে তৈরি করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।’ লেখক চন্দন আনোয়ার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘শত বছরের উপরের এ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা পাঠ করেছেন, আরও বড় বড় মনীষীর স্মৃতিজড়িত এ রকম একটি স্থাপনাকে নতুনভাবে করার নামে ভেঙ্গে ফেলা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। বরং পাশেই আরেকটি নতুন স্থাপনা হোক।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সুজিত সরকার বলেন, ‘এর আগে অলকা সিনেমা হলটি এক সময় রাজশাহীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। সেটি ভেঙ্গে মার্কেট করে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, যারা সাংস্কৃৃতিক কেন্দ্রটি তৈরি করেছিলেন, তাদের নামটিও মুছে ফেলা হয়েছে। এভাবেই ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে যায়।’ গবেষক জুলফিকার মতিন মনে করেন, ‘বই পড়া থাকবে কী থাকবে না, তা নিয়ে উচ্চাভিলাষী কল্পনা করার ব্যাপার এটা নয়। প্রশ্নটা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বাঁচিয়ে রাখার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রাখার। বিবেচনাটা হওয়া উচিত তাই।’ পরিচালনা পর্ষদের মতো স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাও ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি জানান, ভবনটি জরাজীর্ণ। সেটি সংস্কার করে কোন লাভ নেই। ফলে সেটি ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেখানে থাকা দুর্লভ বইগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ভবনটির বর্তমান আদলের একটি রেফ্লিকা তৈরি করে মূল ফটক করা হবে। সেখানে থাকা বইগুলো ডিজিটাল করার কথাও জানান তিনি। তবে রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, শীঘ্রই এটি ভেঙ্গে ফেলা হবে। সেখানে আধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
×