ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমার মিথ্যা বলেই যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমার মিথ্যা বলেই যাচ্ছে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মধ্যেই জাতিসংঘে মিথ্যাচার করেছে মিয়ানমার। এছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে সেটা দেশটির নেত্রী আউং সান সুচির টেলিভিশনে দেয়া বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে দেয়া বক্তব্যে মিয়ানমার বলেছে, নিরীহ বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি এড়াতে সব ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছে তাদের সরকার। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের চলমান সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভান থিও বলেছেন, ‘রাখাইনের মুসলমানদের দলে দলে দেশান্তরী হওয়ার পেছনের কারণ আমাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন’। এটা মিয়ানমারের মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট তার বক্তৃতায় একটিবারের জন্যও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। সেটা না করে সুচি ৫ সেপ্টেম্বরের পর রাখাইনে কোন ধরনের সহিংসতা বা নির্মূল অভিযান হয়নি বলে যে দাবি করেছিলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। ২৪ আগস্ট রাতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে হামলার পর পাল্টা অভিযানে অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও ধর্ষণ ও নিরীহ মানুষজনকে নির্বিচারে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যার অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান থিও জাতিসংঘে দেয়া বক্তৃতায় সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের পাশাপাশি বিদ্রোহীদের হামলায় নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের প্রতিও গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, শুধু রাখাইনের মুসলনমানরাই পালিয়ে (বাংলাদেশে) যায়নি, অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরাও গেছে। সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকার ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ জানিয়ে ভান থিও বলেন, অভিযান পরিচালনার সময় নিরীহ বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি এড়াতে বাহিনীগুলোকে আচরণবিধি মেনে চলতে ও সংযম বজায় রাখতে সব ব্যবস্থা নেয়ার কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তার সরকার লাখ লাখ মানুষের পালিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ভান থিও বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। এছাড়া ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে কোন সংঘাতও হয়নি। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী হামলার পরই রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হয়েছে। অমুসলিমদের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। তবে অনেক মানুষ এখনও সেখানে থেকে গেছেন, বসবাস করছেন। মানবিক সহায়তা আমাদের প্রধান গুরুত্বের বিষয়। তাদের সব অধিকার বিনা বৈষম্যে পূরণ করা হবে। রাখাইনে সেনা অভিযানে প্রাণ বাঁচাতে সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি এবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেননি। জাতিসংঘ ওই সেনা অভিযানকে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে বর্ণনা করেছে। মঙ্গলবার রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি সুচি। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যথাযথ বিচারিক রীতি অনুযায়ী সামাল দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোন প্রকার বৈষম্য না করে যাদেরই দরকার তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা সরকার বুঝতে পারছে। ভান থিও জানান, সঙ্কট সমাধানে কোফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর অধীনে একটি কমিটি হয়েছে। মিয়ানমার ও তার বাইরে থেকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার আরেকটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করবে। প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মিয়ানমার কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে স্বাগত জানাতে চায় তার দেশ। উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার পর অভিযানের নামে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে আসছেন। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে এসেছেন প্রায় সোয়া চার লাখ। তবে বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
×