ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

চাল আমদানি হচ্ছে, অথচ হিমাগারে ৪০ লাখ টন গোল আলু

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চাল আমদানি হচ্ছে, অথচ হিমাগারে ৪০ লাখ টন গোল আলু

দুটো বিপরীতধর্মী খবর দিয়ে শুরু করছি আজকের নিবন্ধটি। আমরা জানি চালের দাম উর্ধমুখী বেশ কিছুদিন যাবত। এর জন্য চালের ঘাটতি যতটুকু না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী চাল নিয়ে ব্যবসায়ীদের ‘চালিয়াতি’। প্রতিদিন এ খবর ‘মিডিয়ায় ছাপা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কিন্তু চালের ওপিঠে যে আরেকটি খাদ্যপণ্যের কোন অভাব নেই, বরং বাড়বাড়ন্ত এ কথা কোন কাগজ গুরুত্ব দিয়ে বলছে না। আমি বলছি গোল আলুর কথা। গুদামভর্তি গোল আলু। কোল্ড স্টোরেজ ভর্তি গোল আলুতে। যদি মানুষ গোল আলু পরিমাণমতো খেত তাহলে চালের ওপর চাপ কমত। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে মানুষ গোল আলুতে যেতে চায় না। আমার পরিষ্কার মনে আছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের কথা। দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। নয় মাস আমাদের কৃষকরা কোন ফসল করতে পারেনি। তারা ছিল প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রামে। সেই সময় মানুষ গম খেতে চায় না, অর্থাৎ আটা। আটার কথা বললেই মানুষ ক্ষেপে যেত। আটার রুটি খাওয়ার জন্যই কী দেশ স্বাধীন করেছি? প্রবল প্রতিরোধ আটার বিরুদ্ধে। তখন রেশন ব্যবস্থা চালু ছিল। রেশনে গম দেয়া হতো। গম ভাঙ্গাতে হতো, আটা পাওয়া যেত। মধ্যবিত্ত গম নিতে চায় না। একই অবস্থা কোল্ড স্টোরেজের আলুর, মানে গোল আলুর। মানুষ ‘হাইব্রিড’ গোল আলু, বড় বড় গোল আলু খেতে চায় না। ‘কোল্ড স্টোরেজের’ হলে তো কথাই নেই। আমার মনে আছে দেশের বাড়ি থেকে লাল ছোট গোল আলু আনতাম। বাড়িতে এটাই সবাই পছন্দ করে। সকালে লাল বিরুই চালের ভাত প্রিয় নাস্তা। এই লাল বিরুই এখন আর দেখি না। একটু মোটা ছিল সিলেটের টেপি চাল। স্বাদ ছিল এর ভাত। স্বাধীনতার পর এসব জিনিসের চাহিদার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে সমাজে। মানুষ এখন আটার রুটি খায়। অথচ গম বাংলাদেশে বেশি উৎপাদন হয় না। হওয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রচুর গম বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় প্রতিবছর। এখন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, এমনকি কর্মজীবীরাও সকালে অন্তত আটার রুটি খায়। বহু লোক রাতেও রুটি খায়। ফলে গমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আবার অন্যদিকে চিকন চালের চাহিদাও বাড়ছে। চিকন চালের ভাত শুধু অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্তরা খায় না। চিকন চালের চাহিদা শ্রমজীবীদের মধ্যে। ড্রাইভার-পিয়ন-দোকান কর্মচারীদের মধ্যেও চিকন চালের বেশ চাহিদা। এই কারণে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মেশিন দিয়ে মোটা চাল চিকন করার ব্যবস্থা হয়েছে। এমনকি তা ‘ব্যাংকফিন্যান্সে’ও হচ্ছে। ওপেন সিক্রেট। চাহিদা না থাকলে তা হতো না নিশ্চয়ই। মুশকিল হচ্ছে এতে চিকন চালের দাম বেশি হয়। চিকন চাল এত উৎপাদনও হয় না। আবার দেখা যায় চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল বাদে অন্য অঞ্চলের লোকেরা এখনও আতপ চাল খেতে চায় না। খোলা বাজারে আতপ চাল বিক্রি করলে ক্রেতারা তা নিতে চায় না। মোটা দাগে দেখা যাচ্ছে দেশে নতুন জাতের চালের চাহিদা বাড়ছে। কারণ এসবের ফলন কম ব্যয়সাধ্য। দেশী পুরনো জাতের ধানের ফলন কম, খরচও বেশি। এতে দেখা যায় পুরনো জাতের ধান বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের খাদ্য চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। এমনকি মানুষ এখন আটার বদলে ময়দাও খাচ্ছে। ময়দার চাহিদা এর ফলে বাড়ছে। বাড়ছে চিনির চাহিদা। গুড় বাজারে পাওয়া যায় না। বলা হয় গুড়ে চিনি ‘মেশানো’ হয়। এসবই ‘পড়তা’ পড়ানোর বিষয়। লাল চিনি বাজারে পাওয়া যায় না। জানা যায় মাসে এখন এক লাখ টনের বেশি চিনি আমাদের লাগে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে শাক-সবজি গ্রহণে। মাছ ও ফল-ফলারি গ্রহণেও মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। অবশ্যই তা ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে, মধ্যবিত্তের আকার বাড়ছে। তাদের প্রয়োজনে শাক-সবজি, চাল-ডাল, মাছ-মাংস, দুধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। দাম যাই হোক এখন সারা বছর নানা ধরনের শাক-সবজি পাওয়া যায়। যে মুলা মানুষ খেতে চাইত না, যে মুলার গ্রামাঞ্চলে কোন বাজার ছিল না সেই মুলা সারা বছর পাওয়া যায়। ফুলকপি, বাঁধাকপি সারা বছর পাওয়া যায়। কচু মানুষ খেতে চাইত না। লালশাক, পালংশাক ইত্যাদির চাহিদা ছিল কম। লাউপাতা, লাউ ইত্যাদির চাহিদা ছিল কম। কিন্তু এখন মানুষ এগুলো প্রাণভরে খায়। স্বাস্থ্য সচেতনতা মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যগুণ সম্পর্কে মানুষ অবহিত হচ্ছে। তাই তার প্রয়োজনে সে সবই খাচ্ছে। সমন্বিত খাদ্য গ্রহণে অনেকেই উৎসাহী হচ্ছে। শুধু মাংসনির্ভরতা অথবা শুধু সবজিনির্ভরতা কমছে। উভয় প্রকারের প্রতিই এখন মানুষের ঝোঁক। এদিকে মাছের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা। দেশী মাছ বলতে বাজারে এখন কিছু নেই। যে ইলিশ ছিল গরিবের মাছ তা এখন রীতিমতো ধনীদের মাছ। পাকিস্তানের শেষের দিকে ঢাকার কোন হোটেলে ভাত-ইলিশ-সবজি-ডাল বারো আনা (পঁচাত্তর পয়সা) থেকে এক টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। পেট ভরে খাওয়া এটা এখন সম্ভব নয়। দেশী মাছ নেই। চাষের মাছ বলে পরিচিত মাছ প্রথম প্রথম মানুষ খেতে চাইত না। এর প্রতি ছিল চরম অনীহা। বেশি দাম দিয়ে হলেও দেশী মাছ কিনতে চাইত মধ্যবিত্ত। কিন্তু আস্তে আস্তে এই অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। পাবদা, শোল, পুঁটি থেকে প্রায় সব ধরনের মাছই এখন চাষের মাছ। রুই-কাতলা তো বটেই। মানুষ তা খাচ্ছে। আজকের দিনের ছেলে-মেয়েদের কাছে অবশ্য চাষের মাছ আর দেশী মাছের কোন পার্থক্য নেই। তারা নরম ব্রয়লার মুরগি পছন্দ করে। বড় বড় হোটেলে তা পাওয়া যায়। দেশী মুরগির দাম আকাশচুম্বী। মানুষ বাধ্য হয়ে ব্রয়লার মুরগি অথবা ‘পাকিস্তানী’ বলে কথিত মুরগির দিকে ঝুঁকছে। তরুণ-তরুণীরা যায় রেস্তরাঁয়। পিৎজা দোসা ইত্যাদি তাদের খাবার। ফলের ক্ষেত্রেও তাই। বাজারে বড় বড় পেয়ারা এখন আর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না। ‘লটকন’-এর আকার বড় বড়। পেঁপের জাত পরিবর্তন হয়েছে। নানা নতুন ধরনের ফল-ফলারি বাজারে আসছে। এসব পরির্বতনের ফলে কৃষকের কাছে নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ধান, পাট, কলাই ইত্যাদি ছাড়া কৃষকের কোন ফসল ছিল না। সবজির বাজার ভাল ছিল না। এখন বিচিত্র সব খাদ্যপণ্যের বাজার জমে উঠেছে। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন নানা ধরনের সবজি চাষ হয়। এর বাজারও ভাল। নরসিংদীর আশপাশ, বগুড়ার কয়েকটি অঞ্চল, বিক্রমপুরের কিছু এলাকা ঢাকাতে সবজি সরবরাহ করে, যা স্বাধীনতার পূর্বে স্বপ্নের বিষয় ছিল। বলাইবাহুল্য, কৃষক এতে উপকৃত। চিরায়ত পণ্য উৎপাদন করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন চাল উৎপাদন তার জন্য এখন একটা শস্তিমূলক ব্যবস্থা। টমেটো ইত্যাদি অনেক সবজি আছে, যা উৎপাদন করার পর কৃষক এসবের দাম পায় না। তাই বিকল্প সবজি হওয়াতে কৃষকের এখন কিছুটা লাভ হয়েছে। এদিকে সমন্বিত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের পুষ্টির অভাব কাটছে। অবশ্য তা এখনও সন্তুষ্টির পর্যায়ে যায় না, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের শিশুরা এখন দারুণ অপুষ্টিতে ভুগছে। এই যে এত কথা বললাম খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়ে এরই মধ্যে একটা খবর আছে, যা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। যেমন গোল আলুর কথা। এই মুহূর্তে দেশে চাল নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। চোখের সামনে আমরা দেখতে পেলাম চালকলের মালিক, চাতালের মালিক এবং চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা কী করে চালের একটা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছে। অজুহাত দুটো বন্যা। সিলেটের ছোট আকারের একটা বন্যা। দুই মাস পরে উত্তরাঞ্চলের আরেকটা বড় বন্যা। প্রাকৃতিক এই কারণে চালের উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। যতটুকু কম হয়েছে তার চেয়ে বেশি চাল আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে। চাল আসছে বিদেশ থেকে। যদিও চালের স্টক কিছুটা কম, তথাপি সরকার খাদ্য বণ্টন কর্মসূচী চালু রেখেছে। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে চালের দাম খোলা বাজারে কিছুটা বাড়লেও সঙ্কটাবস্থা তৈরি হয়নি। বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে খবর হিমাগারে এই মুহূর্তে ৪০-৪৫ লাখ টন গোল আলু অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দাম নিম্নমুখী, রফতানিও কমেছে। ২০১৬ সালে দেশে গোল আলু উৎপাদন হয় ৮০ লাখ টন। ২০১৭ সালে হয়েছে এক কোটি টন। অথচ এত চাহিদা নেই। লোকসান সহ্য করতে না পেরে ইতোমধ্যেই ৩০-৩৫টি হিমাগার বন্ধ হয়ে গেছে বলে খবরে প্রকাশ। হিসাবে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার গোল আলু আটকা পড়েছে। সামনে শীতকাল। নতুন আলু উঠবে। এতে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। কৃষকরা কী এবার বেশি আলু সরবরাহ করবেন, নাকি তারা এবারের লোকসান দেখে আলু চাষ কম করবেন। এদিকে আরেক বিপদ হবে ব্যাংকগুলোর। আলু চাষীরা লোকসান দিলে, হিমাগারের মালিকদের লোকসান হলে হিমাগার বন্ধ হলে, ব্যাংকের লোনের টাকা ফেরত আসবে না। শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এই সমস্যা থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায় চালের টানাটানি; কিন্তু গোল আলুর সরবরাহ প্রচুর। কিন্তু মানুষ বেশি বেশি গোল আলু খেতে পছন্দ করে না। এ নিয়ে অনেক কথা হয়। আমাদের খাদ্য তালিকায় যদি গোল আলুর ব্যবহার আরেকটু বাড়ত তাহলে নিশ্চিতভাবেই চালের ওপর চাপ কমত। গোল আলু জমিতে ফলে বেশি, খরচও কম। ধান উৎপাদনের হার কম, খরচও বেশি। কিন্তু আমাদের খাদ্য তালিকায় গোল আলুর কদর কম। এটা আমাদের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×