ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

সিনেমার দর্শক হাইজ্যাক

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সিনেমার দর্শক হাইজ্যাক

ছাপা হওয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইনে প্রকাশিত পত্রিকায় ঈদ সিনেমার রিভিউ লেখা হয়েছে অনেক। সব রিভিউ এক করে এক শ’ নম্বরে মার্কিং করলে তেত্রিশ আসবে না। অর্থাৎ সাধারণ পাস মার্ক মিলবে না। সদ্য মুক্তি পাওয়া ঈদ-উল-আযহার সিনেমা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভক্ত মহলে মন্তব্য ছিল নেতিবাচক। রোজার ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত সময় পেরিয়েছে প্রায় তিন মাস! এই তিন মাসে বিনোদনের ক্ষুদা নিবারণের অন্যতম রসদ সিনেমার সংখ্যা এবং সাফল্য নিয়ে কথা আলোচনা করলে তার শ্রী খুব একটা ভাল আসে না। ‘নবাব’ ‘বস২’ ‘রাজনীতি’ সিনেমার গল্প, কিংবা সাফল্য নিয়ে আলোচনা করলে কেবল হল মালিকরাই সন্তোষ প্রকাশ করবেন। কারণ, হল মালিকরা ঈদ উপলক্ষে লাভের যে টার্গেট ঠিক করেছিলেন তা ওই সিনেমা তিনটি পূরণ করতে পেরেছে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় অনেক সিনেমা হল এখন আর সারা বছর খোলা থাকে না। খুব কম সংখ্যক সিনেমা হল সারা বছর খোলা থাকে। এর মধ্যে যেগুলো সারা বছর খোলা থাকে না, সেগুলোর হল মালিকরা অপেক্ষায় থাকেন বিশেষ করে, দুই ঈদ সিনেমার। তুলনামূলক বড় বাজেট। নেগেটিভ-পজেটিভ মার্কেটিং। এর সঙ্গে যোগহয় আমাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস ঈদে সদলবলে হল ভর্তি করে নতুন সিনেমা দেখা। সঙ্গত কারণে, ঈদ সিনেমার নির্মিত অর্থ দর্শকদের পকেট থেকে উঠে যায়। তাই তো সিনেমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ হল মালিকরা ঈদের সিনেমা বেশি নিরাপদ মনে করে। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে যে সিনেমাগুলো মুক্তি পায় তার বেশিরভাগই ব্যর্থার অতলে তলিয়ে যায়। সফলতা বা দর্শকপ্রিয়তা পায় হাতেগোনা দু-একটি। একাধিক রিভিউতে ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও ‘নবাব’ ‘বস২’ ব্যবসা সফল। কিন্তু তারপর...দুই মাস দশ দিনে (প্রায় দশ সপ্তাহ) অর্থাৎ ঈদ-উল-আযহার আগ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ‘ভংয়কর সুন্দর’ ‘রাইয়ান’ ‘মারছক্কা’ ‘গ্রাস’ এসব সিনেমার কোন দিকই উল্লেখযোগ্য ছিল না। যা নিয়ে দুই কলম লেখা যায়। এর মধ্যে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সিনেমার পরিচালক সিনেমা মুক্তির দিন কয়েক আগে এক প্রিমিয়ার অনুষ্ঠনে সাংবাদিকদের সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন, অন্তত হলে মুক্তির পর, প্রথম সাত দিন কেউ যেন তার সিনোমর রিভিউ না লেখে। তার এই অনুরোধ ছিল অসমীচীন। কারণ তার ওই অতি দুর্বল সিনেমাটিকে দর্শকদের ওপর এক রকম চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্য ছিল। অনেক পত্রপত্রিকার সাংবাদিকরা অবশ্য তার ওই অনুরোধ রেখেছিলেন। তার পরও সিনেমাটির বর্তমান ও ভবিষ্যত কোনটাই রক্ষা করা গেল না। বাকি সিনেমাগুলোর অবস্থা এতটাই রুগ্ন ছিল যে, কোন কোন এলাকায় সিনেমা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগেই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনকার শো চালানো হবে না। অবশ্য এ সিদ্ধান্তের কারণে তাদের কোন অসুবিধায় পরতে হয়নি। কারণ, শোয়ের আগে টিকেট বিক্রি হয়েছে দু-থেকে তিনটি। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়! এর মধ্যে চলে আসে কোরবানির ঈদ। মুক্তিপায় তিনটি সিনেমা। আসলে ঈদের জন্য এখন তিন সংখ্যক সিনেমাই নিয়ম! এমনটাই দেখা যাচ্ছে। রংবাজ, অহংকার, সোনাবন্ধু, ছিল গত ঈদের সিনেমা। এই তিনটির মধ্যে শাকিব-বুবলির অভিনীত সিনেমা দুটি প্রায় দু’শ’ হলে মুক্তি পায়। আর পরীমণি, পপি ও ডিএ তায়েব অভিনীত সিনেমা সোনাবন্ধু মুক্তিপায় পঁয়ত্রিশটি সিনেমা হলে। লেখার শুরুতেই বলেছি, এই সিনেমা নিয়ে রিভিউ লেখা হয়েছে অনেক। সব রিভিউর মার্ক যোগ করে এক শ’ নম্বরে মার্কিং করলে তেত্রিশ আসবে না। আসলে ব্যাপারটা তাই। ঢাকার হাতেগোনা কয়েকটা সিনেমা হল বাদ দিয়ে, সারাদেশের হলগুলোর দর্শকচিত্র ছিল এবারের ঈদ সিনেমার জন্য সত্যই হতাশাজনক। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যারা নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখেন। খোঁজখবর রাখেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে এবারের ঈদ সিনেমা নিয়ে কথা হয়। আয়ুব আল-আমিন। পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। জীবনে বোধ-বুদ্ধির শুরু থেকেই সিনেমা দেখছেন। বাংলা সিনেমা বা ঢাকাই তো অবশ্যই। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ছিলেন। এলাকার বন্ধুবান্ধব ছোট ভাইদের নিয়ে প্রতি ঈদে স্থানীয় হলে সিনেমা দেখেন। এবারও ছিল তার একই রুটিন। এবারের সিনেমা দেখে সে এবং তার ঘনিষ্ঠজনের অভিমত অভিন্ন। তিনি বলেন, ‘সামান্য টাকা খরচ করে সময় নষ্ট করেছি, তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা, সিনেমার নামে লাখো কোটি টাকা খরচ করে হাবিজাবি কি সব বানাছে। তাদের অনুরোধ করি, তারা যেন এই অর্থ নষ্টের নিষ্ঠুর খেলা আর না খেলেন। এটা আমার অনুরোধই ধরেন।’ রুবেল রোহান। অনার্স ফোর্থ ইয়ার। খুব বাংলা সিনেমা দেখেন। ইন্টারনেট-ইউটিউব ছাড়াও প্রাই হলে যান। তিনি ও জানালেন, হতাশার সুরে, দেখলাম সিনেমার নামে বুঝলাম না। গল্প, চিত্রনাট্য, মিউজিক, কালার, এডিটিং ইত্যাদি ইত্যাদি সত্যিকার অর্থে সিনেমার ক্ষেত্রে এসব বিষয় এখন আর মোটেও মননশীল নয়। আর পেষাদারিত্বের কেন লক্ষণও স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে দিন দিন খুব রুগ্ন অবস্থায় যাচ্ছে আমাদের সিনেমা ও এর দর্শক। যে কারণে স্বেচ্ছায় হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে আমাদের দর্শক। অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র নায়ক হিসেবে শাকিব খান বুঝে ফেলেছেন, তাকে ছাড়া দর্শক এবং প্রযোজক-পরিচালকের ভিন্ন কোন গতি নেই। কার পেছনে তারা অর্থ ঢালবেন! সেটা তিনি ভাল ভাবেই বুঝেছেন। যে কারণে তার ব্যক্তিগত আচরণ ও দাম্ভিকতা তার সহকর্মী থেকে শুরু করে ভক্তদের বিব্রত করে। সব মিলিয় আপাতত কোন ইতিবাচক দিক কিংবা উচ্চাশা করা যাচ্ছে না আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে।
×