ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চালের দাম বস্তায় কমেছে দেড় শ’ টাকা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চালের দাম বস্তায় কমেছে দেড় শ’ টাকা

এম শাহজাহান ॥ মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর ঢাকার পাইকারি বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি দাম কমেছে ১-৩ টাকা। অর্থাৎ ৫০ কেজির বস্তায় কমেছে দেড়শ’ টাকা। আগামী দু’একদিনের মধ্যে খুচরা বাজারে চালের দাম কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের দফায় দফায় অভিযান চালানোর ফলে কুষ্টিয়া, নাটোর দিনাজপুর ও ফরিদপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ মজুদকৃত চালের সন্ধান পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এছাড়া দাম কমানোসহ সঙ্কট মেটাতে জি টু জি ভিত্তিতে ৯ লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই লাখ টন সরকারের হাতে এসে পৌঁছেছে। বাকি চাল আগামী নবেম্বর মাসের মধ্যে দেশে আনা হবে। মোকামগুলো থেকে পাইকারি বাজারে চালের সরবরাহ বেড়েছে। তবে খুচরা বাজারে আগের দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। মিলমালিক, আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশকিছু দাবি দাওয়া মেনে নেয়ায় চালের দামে স্বস্তি ফিরে আসবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, চালের দাম কমতে শুরু করেছে। নবেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরে প্রথমে নতুন ফসল উঠবে। কাজেই চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই। চালের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। চালের কোন সঙ্কট নেই। বন্যা ও হাওড়ের পানি বেড়ে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি চাল আমদানি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চালের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান অব্যাহত থাকবে। যারা চাল মজুদ করবে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান কঠোর। কোন ছাড় নেই। সেক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, মজুদ বিরোধী আইনসহ যা যা আছে সব প্রয়োগ করা হবে। অবৈধ মজুদ পেলেই মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমদানি করা চালের ক্ষেত্রে চটের বস্তার ব্যবহার তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এর সুফল জনগণ পাবে। তবে দেশের ভেতরে ১৭টি পণ্যের ক্ষেত্রে প্যাকেজিং আইন যথারীতি বলবৎ থাকবে। জানা গেছে, অভিযান শুরুর একদিনের ব্যবধানে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে অস্থিরতার সুযোগে বেশকিছু মিল মালিক এখনও চাল সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে-আড়তদারদের। লাগামহীন বাড়তে থাকা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রবিবার উত্তরাঞ্চলের প্রশাসনকে মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সরকারের এ নির্দেশনার পরপরই সরব হয় প্রশাসন। চালের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ায় রশীদ এগ্রো ফুড মালিকের দুটি গুদাম ছাড়াও অভিযান চলে বিশ্বাস এগ্রো ফুডের মিলে। সোমবার নাটোরের সততা, চৌধুরী ও কে এম ট্রেডাসের মালিককে জরিমানা এবং রাজশাহীতে হামিম এগ্রো এবং আসলাম রাইস মিল মালিককে গ্রেফতার ও জরিমানা করা হয়। আর তাতেই স্থিতিশীল মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের দাম। এছাড়া বাবু বাজার ও বাদামতলী বাজারের আড়তগুলোতে চালের দাম কমতে শুরু করে। আড়তদাররা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এমন চিহ্নিত আট-দশটজন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকের গুদামে অভিযান অব্যাহত রাখলে দাম আরও কমবে। তাই অভিযান অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এদিকে দফায় দফায় ধান ও চালের বাজার বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি কুষ্টিয়ার আবদুর রশীদসহ ১০ চালকল মালিককে দায়ী করছেন হাসকিং মিল মালিকরা। বন্যা ও দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে তারাই মৌসুমের শুরুতে কম মূল্যে দেশের বেশিরভাগ ধান কিনে মজুদ গড়ে এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ছোট চালকল মালিকরা মনে করেন, অটো মিল মালিকদের পাশাপাশি হাসকিং মালিকদের ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করলে এককভাবে কারও পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানের পর মিল মালিকরা নড়েচড়ে বসেছেন। চালকল মালিক সমিতির শীর্ষ নেতারা মিল মালিকদের মিডিয়াকে সব ধরনের তথ্য দিতে বারণ করেছেন। এদিকে নাটোরে অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের অভিযান এবং ওএমএসে দেশীয় চাল বিক্রির কারণে একদিনের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা কমেছে। অভিযানের ফলে বাজারে চালের আমদানিও বেড়েছে। পাশাপাশি খোলাবাজারে সরকারীভাবে দেশী চাল ৩০ টাকায় বিক্রি করার প্রভাব পড়েছে বাজারে। চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মিল মালিক ও মজুদদাররা স্থানীয় প্রশাসনের ভয়ে কিছুটা কম দামে চাল বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন। এছাড়া বাজারে চালের আমদানি বাড়লেও ওএমএসের কম দামের চাল কিনতে ছুটছেন নিম্নআয়ের ক্রেতারা। ফলে চালের বাজারে কমেছে ক্রেতা। নবেম্বরের মধ্যে জি টু জি ভিত্তিতে ৯ লাখ টন চাল আনা হচ্ছে আপৎকালীন সঙ্কট মেটাতে দ্রুত জি টু জি বা সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে ৯ লাখ টন চাল আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি নতুন করে আরও ৫০ হাজার মেট্রিকটন সিদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে একটি থাই কোম্পানির কাছ থেকে ৪৩৮ ডলার দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে বুধবার সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এই প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক কোটেশনের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্যাকেজ-৪ এর আওতায় এই চাল কেনা হবে। হাওড়ে আগাম বন্যায় ফসলহানির পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুই দফার বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া রোগবালাইয়ের কারণেও এবার ধানের ফলন অনেক কম হয়েছে। হাওড়ে ফসলহানির পর থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে চালের সরকারী মজুদ তলানিতে নেমে আসায় বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে দেশে চালের দাম সকলকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাজার সামাল দিতে চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে দুই শতাংশে নামিয়ে আনে সরকার। সরকারী মজুদ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে সরকারীভাবে মোট ১৫ লাখ টন চাল ও ৫ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে চাল রফতানিতে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে চালের দাম ফের বাড়তে শুরু করে। গরিবের মোটা চালের কেজিও ৫০ টাকায় পৌঁছায়। এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব মোঃ কায়কোবাদ হোসাইন বলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মধ্যে অনেক সময় অনেক কোম্পানি চাল আমদানি করে দেয়ার জন্য চুক্তিভুক্ত হলেও পরে আমদানি করে না। তাই সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু জি টু জি-তে চুক্তি হলে চাল আমদানি কনফার্ম থাকে এবং অবশ্যই চালে মান ভাল হয়। তিন মাসের জন্য পাটের বস্তা ব্যবহারে শিথিলতা চাল আমদানি ও সরবরাহে ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে নিয়ে পাট মন্ত্রণালয় তিন মাসের জন্য পাটের বস্তা ব্যবহারে শিথিলতা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতেও চালের দাম কমবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পাট আমাদের জাতীয় সম্পদ। রফতানিকৃত পাঁচটি পণ্যের তালিকায় পাট রয়েছে। পাটচাষীদের উৎসাহিত করতে প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে। কাজেই পাট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই সরকারের সিদ্ধান্ত। আমাদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। আমরা সবাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সরকারের কাজ করছি। তিনি বলেন, চাল সঙ্কট এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সেদিক বিবেচনা করে আগামী তিন মাসের জন্য আমদানি করা চাল আনতে চটের বস্তা ব্যবহারে সরকারী বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। আগামী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই শিথিলতা কার্যকর থাকবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম, ফরিদপুর ও গাজীপুর সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে খাদ্যগুদামগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর মাঝিঘাটা এলাকায় চালের অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বারোটায় অভিযান শুরু হয়ে চলে বিকেল পর্যন্ত। অবৈধভাবে চাল মজুদের দায়ে ওই সময় এক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে তিন মাসের কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দোকানে মূল্যতালিকা না থাকায় গাজীপুর জেলা শহরের তিন দোকানিকে ছয় হাজার পাঁচশ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শিউলী ট্রেডার্স নামের দুটি দোকানের মালিক নূরুল ইসলামকে ৫০০ টাকা ও বাচ্চু খন্দকারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং মোজাম্মেল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ফরিদপুরে চালের বাজারে অভিযান চালিয়ে তিন ব্যবসায়ীকে মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই তিন ব্যবসায়ী ১০৭ মেট্রিক টন চাল মজুদ করেছিল। এছাড়া বগুড়ার সারিয়াকান্দির একটি গুদাম থেকে ভিজিডির ১৪২ বস্তা চাল জব্দ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
×