ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের আরও গুলিবর্ষণ

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের আরও গুলিবর্ষণ

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টসহ সবক’টি স্থানে চলছে সেনা টহল। আর রাখাইন রাজ্যের চার শহরে অর্থাৎ বুচিদং, রাচিদং, সিটওয়ে ও মংডুর বিভিন্ন এলাকায় এখন চলছে রাখাইন সন্ত্রাসীদের রোহিঙ্গাবিরোধী মারমুখী উৎপাত। সোমবার রাতে ওপারের আসারতলীর চেংছড়ি এলাকা থেকে এপারের ৩১ বিজিবি ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করেছে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর সার্চ লাইট দিয়ে এপারের পরিস্থিতি অবলোকন করেছে। অপরদিকে, মঙ্গলবারও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উনচিপ্রাং ও শামলাপুর দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন অব্যাহত ছিল। উত্তাল নাফ নদী পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা যে দুঃসাহসিক পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে তাতে সার্বক্ষণিক তাদের হাতছানি দিচ্ছে ভয়াল মৃত্যু। মঙ্গলবার পর্যন্ত গত দু’দিন এপারের ন্যায় সীমান্তের ওপারেও ব্যাপক বর্ষণ হয়েছে। বর্ষণ পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে কাকভেজা হয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থেমে নেই। অনুপ্রবেশকারী নতুন রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে, রাখাইন জুড়ে সেনা ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের নিধনযজ্ঞ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ায় তাদের পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। তাই শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে তারা পালিয়ে আসছে। একদিকে রোহিঙ্গাদের ঢল, অপরদিকে ভারি বর্ষণ। তার ওপর প্রয়োজনীয় ত্রাণের অভাবের কারণে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রীতিমত আহাজারি চলছে। সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা প্রতিদিন বাড়ছে। তবে এ প্রক্রিয়া এখনও শৃঙ্খলায় আনা যায়নি। সরকারী উদ্যোগে খোলা আটটি লঙ্গরখানায় অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহ চলছে। এদিকে, উত্তর মংডুর নন্দাখালি এলাকার বলীবাজারে রোহিঙ্গাদের বেশকিছু বসতঘর নতুন করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বুচিদং, গুজরান এলাকায় সেনা অভিযানে নতুন করে অর্ধশত যুবককে পাকড়াও করার পাশাপাশি নতুন কয়েকটি দোকানপাটও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় ভারি বর্ষণ হয়েছে। এতে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা পৌনে ৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। তবে সরকারী পরিসংখ্যানে ৪ লক্ষাধিক। উস্কানিমূলক আরও গুলিবর্ষণ ॥ মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও বর্ডারগার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা বিনা উস্কানিতে সীমান্তের জিরো লাইনে গুলি ছুড়েছে। সোমবার রাতে নাইক্ষ্যংছড়ির আসারতলী সীমান্তের সাতমারাঝিরি বরাবর ওপারের চেংছড়ি থেকে দেশটির সরকারী বাহিনীর সদস্যরা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়েছে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গার মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ফাঁকে বহু রোহিঙ্গা জিরো পয়েন্ট থেকে এ পাড়ে পালিয়ে আসে। এছাড়াও মিয়ানমার সেনারা জিরো লাইনে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লাইটের আলো ছড়িয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানানো হয়, সোমবার রাত ৯টার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ির সাতমারাঝিরি বরাবর সীমান্তে মিয়ানমার থেকে ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা গেছে। এতে স্থানীয় ও সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে যায়। মিয়ানমার সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে স্থল মাইন বসানোর পর সেখানে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ইতোপূর্বে মারা গেছে বহু রোহিঙ্গা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা এসে সাতমারাঝিরি পয়েন্টে জিরো লাইনে আশ্রয় নিয়েছিল। সেনাবাহিনী ওই আশ্রিত ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার আজিম মঙ্গলবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তারা প্রায় সময় গুলি ছুড়ে। সোমবার রাতেও বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে নয়, জিরো লাইনে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের দিকে গুলি ছুড়েছে। এটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের পুরো লঙ্ঘন। সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের ঘটনা মিয়ানমার সেনাবাহিনী অব্যাহত রেখেছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ৮টি পয়েন্টে প্রায় ২০-২৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে বড়ছনখোলা, সাতমারাঝিরি, আসারতলী, জামছড়ি, দু’টি রাবার বাগান, চাকঢালা ও ফুলতলী এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে এসব অসহায় রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর মধ্যে একাধিক দুর্গম এলাকাও রয়েছে। সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সব থেকে ভয়ানক আতঙ্ক ২০৮ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে পুঁতে রাখা মরণঘাতী স্থলমাইন। নোম্যান্স ল্যান্ডের জঙ্গল ঝোপঝাড়ে পুঁতে রাখা এসব মাইনের আঘাতে ইতোপূর্বে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে বহু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। অরক্ষিত সীমান্তের ওপাশে ২০ থেকে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিলেও ত্রাণ চিকিৎসা এখনও খুব একটা পৌঁছেনি । সীমান্তের ৪৪ নম্বর পিলারের পাশেই গেল কয়েকদিন ধরে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। মাইনের পাশাপাশি বর্তমানে গুলিবর্ষণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির পুরো এলাকায়। এছাড়া সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে প্রতিদিনই বাড়ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যাও। এদিকে সোমবার রাতেও মংডুর নন্দাখালী ও বলিবাজারে রোহিঙ্গা বসতি-দোকান জ্বালিয়ে দিয়েছে-সেনা সদস্য ও রাখাইনরা। বুচিদংয়ে বুজরাংশং ঘাঁটির সেনা সদস্যরা। দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গাকে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা করেছে। সিটওয়ের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গা পল্লী এলাকাগুলোতে সেনাটহল জোরদার রয়েছে। নিয়মিত অভিযান ও তল্লাশির নামে রোহিঙ্গারা বহুমুখী হয়রানি ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। দেশটির সেনা প্রধানের রোহিঙ্গাবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্যের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে রাখাইন সন্ত্রাসীরা। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে সেনা অভিযানের সঙ্গে স্বল্পসংখ্যক রাখাইন সন্ত্রাসী যোগ দেয়। এখন এসব সন্ত্রাসীদের উৎপাত সেনাবাহিনীর চেয়েও বেশি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে রাখাইনে একের পর এক জ্বলছে রোহিঙ্গা গ্রাম। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইছে সেখানে থাকা অবশিষ্ট আরও ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। সিটওয়ে, বুচিদং ও মংডু এলাকায় যেসব রোহিঙ্গা পল্লীতে আগুন দেয়া হয়েছে, ওসব পল্লীর বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও কিছু কিছু রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাদের ঘর-বাড়িগুলোতে আগুন দেয়ায় জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। ওরা এখন আশ্রয়হীন, গৃহহীন এক কথায় সর্বহারা। স্যাঁতসেঁতে রোহিঙ্গা ঝুপড়ি ॥ উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে ছোট ত্রিপলের ছাউনির নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই করার ব্যবস্থা নিলেও অতি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ ঝুপড়ি। এতে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মৌসুমি বৃষ্টিপাতে কুতুপালং, বালুখালী, নয়াপাড়া, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় আশ্রিত নতুন রোহিঙ্গার ঝুপড়িগুলো ভিজে একাকার হয়ে যায়। রাতভর বৃষ্টিতে ভিজে স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটি ও কাদার কারণে নির্ঘুম রাত কাটায় রোহিঙ্গারা। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢল নামে পার্শ্বস্থ খাল ও ছড়ায়। পাহাড়ের পাদদেশে, জিরো পয়েন্টে বা ঢালুতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, রাতে তাদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ে। সীমান্তে মোবাইল নেওয়ার্ক বন্ধ ॥ নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার সব মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখার তৎপরতা চলছে। জাতীয় স্বার্থ দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দাঁড়ানোর প্রেক্ষিতে মোবাইল অপারেটর সংস্থার টাওয়ার কানেকশন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। উখিয়া কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন বাংলালিংকের টাওয়ার বন্ধ করার কাজ করার কারিগরি টিমের সদস্য আবু বকর সিদ্দিক স্বপন জানিয়েছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হওয়ায় টেকনাফ থেকে উখিয়া, বান্দরবান পর্যন্ত সীমান্ত এলাকার সব টাওয়ারের সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। তিনি জানান, সীমান্ত এলাকায় আগামীতে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরের দিকে নেটওয়ার্ক চালু থাকবে। উল্লেখ্য, মোবাইল অপারেটরদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্য জুড়ে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করে থাকে। টেকনাফ, উখিয়ায় বিভিন্ন অপারেটরের টাওয়ার থাকায় নিকটবর্তী সীমান্ত এলাকা অর্থাৎ রাখাইন রাজ্য জুড়ে রোহিঙ্গারা এ সুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে এপারের সঙ্গে তাদের রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। এ সুবিধার কারণে বহু আগে থেকেই ওপার থেকে চোরাচালান চক্র ও মাদক পাচারকারী চক্রের সদস্যরা মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থার অপব্যবহার করে আসছে। ৬ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত ॥ ভারি বৃষ্টিপাত হলেও উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কেন্দ্র অনেকটা ফাঁকা রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে এই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে কিছু কিছু রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কেন্দ্রের সমন্বয়ক মেজর রেজা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে ভারি বর্ষণ হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি প্রতিকূলে রয়েছে। আর এ কারণেই নিবন্ধের জন্য রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি হ্রাস পেয়েছে। তিনি জানান, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ওই নিবন্ধন কেন্দ্রে ৬ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ নিবন্ধিত হয়েছে। নিবন্ধন কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষমাণ রোহিঙ্গা শফিউল্লাহ, সাজেদা খাতুন ও রহিমা জানান, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রোহিঙ্গারা নিবন্ধন কেন্দ্রে আসতে পারেনি। এছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের উৎসাহও খুব বেশি নেই। এর মূল কারণ হিসেবে জানা গেছে, নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের আগামীতে পুনরায় রাখাইন রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং সেখানে গেলে তাদের অস্বাভাবিক অবস্থার জীবনযাপন করতে হবে। আর বাংলাদেশে থাকতে পারলে আশ্রয়ের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ত্রাণ সামগ্রীও পাওয়া যাবে। মূলত এসব কারণেই রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় উৎসাহ খুব বেশি নেই বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যেভাবে হোক রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় আনা হবে। ইতোমধ্যে সরকার পক্ষে সকল রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকার জনসাধারণকে অবৈধভাবে তাদের গোপনে আশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারেও বার্তা দেয়া হয়েছে। ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা ॥ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার পর রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ ক্যাম্প ও অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো থেকে প্রতিদিনই পালিয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সুবাদে এরা সহজেই তাদের কাছে আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়ক পথে এবং সমুদ্র পথেও রোহিঙ্গারা কক্সবাজার অঞ্চল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার জন্য এদের উস্কানি দিচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি গ্রুপ। এরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্রে জানানো হয়েছে। তবে সরকার পক্ষে পালানোর সবক’টি পথে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সড়কপথে বিভিন্ন যানবাহনে প্রতিনিয়ত চলছে তল্লাশি। এতে বহু রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে আটক হয়ে পুনরায় নির্ধারিত ক্যাম্পে ফেরত গেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে পাহাড়ে অপূরণীয় ক্ষতি ॥ কক্সবাজার ও আশপাশে যেসব স্থানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য পাহাড় কাটা হয়েছে, সে কারণে যে ক্ষতি নেমে এসেছে তা আর কখনও পূরণ হবে না বলে স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনসূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কেননা, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা তাদের ইচ্ছামত রাস্তার দুপাশ ধরে গহীন অরণ্য পর্যন্ত অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে। তবে বর্তমানে প্রশাসনের উদ্যোগে রাস্তার দুপাশ থেকে রোহিঙ্গাদের অবস্থান সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে উখিয়া, টেকনাফ সদর এলাকায় ইতোপূর্বে যে অস্থায়ী রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। রাখাইনে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার সমঝোতা স্বাক্ষর ২৯ সেপ্টেম্বর ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করার পর সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে রাখাইন রাজ্য সরকার। এ লক্ষ্যে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর জয়েন্টভেঞ্চারের একটি কোম্পানির সঙ্গে সরকার ও বিনিয়োগকারীদের স্মারক সমঝোতা স্বাক্ষর হতে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। এ জন্য মিয়ানমার সরকার মংডু জেলায় কানইয়েন চং গ্রামে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে দেশটির সরকার। মিয়ানমারে বিভিন্ন গ্রামে যেসব রোহিঙ্গা এখনও বাড়িঘর ছেড়ে যায়নি, তাদের ওপর নতুন করে কি মুসিবত নেমে আসতে পারে এ নিয়ে তারা শঙ্কায় রয়েছে। কেননা যেদিন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার চুক্তি স্বাক্ষর হবে, সেদিন ওই এলাকার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সেনা সদস্যরা। মিয়ানমার সরকারের পক্ষে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজটি বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, এটি আগেকার সরকার এখানে একটি বাণিজ্য-অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এই সরকার শুধু সেটিকে আরেক ধাপ অগ্রসর করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ছাড়াও বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমূল্যে জমি বরাদ্দ পাবে। আবার অনেককে বিনামূল্যে জমি দেয়ার চিন্তা ভাবনা রয়েছে সরকারের। শরণার্থীদের সহযোগিতা দেবে জার্মানি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ছয় কোটি ইউরো সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মান সরকার। সরকারের জরুরী ত্রাণ তহবিল থেকে এই সহযোগিতা দেয়া হবে। জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফান সাইবার্ট সোমবার বার্লিনে এই ঘোষণার কথা জানান। স্টেফান সাইবার্ট বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থী এই মুহূর্তে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ছাড়া এ ঘটনা মানবতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন। বার্লিনের এই সাহায্য জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের সহযোগিতায় সীমান্তের দুই দিকে জরুরী খাদ্য, চিকিৎসা ও মৌলিক চাহিদার জন্য ব্যয় করা হবে। তদন্ত চালাতে চায় জাতিসংঘ ॥ মিয়ানমারে ইতোমধ্যে সংঘটিত গণহত্যা ও অব্যাহত বর্বরতার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করতে চায় জাতিসংঘ। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাখাইন রাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকারের সুযোগ চাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার জাতিসংঘ তথ্য অনুসন্ধান মিশনের তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারকে নতুন করে চিন্তা করারও আহ্বান জানানো হয়েছে সংস্থার পক্ষ থেকে।
×