ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন মন্ত্রী ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত আসে

আজ থেকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা কমবে

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আজ থেকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা কমবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ চালের দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তারা চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী বলেন, আজ থেকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা করে কমে যাবে। চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে চালকল মালিক, আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এ সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। সাংবদিকদের উপস্থিতিতে সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনার পর চাল ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাধা দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বৈঠকের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে চালের কোন ঘাটতি নেই। বর্তমানে দেশে এক কোটি মেট্রিক টনের বেশি চাল আছে। বাজারে কোথাও চালের ঘাটতি নেই। দেশে খাদ্যের কোন সঙ্কট নেই। তারপরও চালের দাম কেন এত বেশি বাড়ছে? ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে সঙ্কট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। যেভাবেই হোক এটা কমাতে হবে। এ বিষয়ে কোন সমস্যা থাকলে ব্যবসায়ীদের তা তুলে ধরতে বলেন। এরপরই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ব্যাবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, দেশে খাদ্যের কোন অভাব দেখি না। কোন সঙ্কট নেই। তাহলে চালের দাম এত বাড়বে কেন? তিনি বলেন, দেশে এখনও প্রচুর চাল রয়েছে। কৃষকের ঘরে চাল মজুদ রয়েছে। মিলারদের কাছেও মজুদ রয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতের একটি অখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় যে, ভারত চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত কোন চাল রফতানি করবে না। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমাদের দেশে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমরা খবর নিয়ে দেখলাম এ খবর সঠিক নয়। ভারত এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। একটি গুজবের ওপর ভিত্তি করে অস্বাভাবিকভাবে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন চালের দাম কমাতে আপনাদেরই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, নালিতাবাড়ী সরকারী গুদামে এক হাজার ৭শ’ মেট্রিক টন চাল আছে। নকলায় আছে এক হাজার ১শ’ মেট্রিক টন। হাওড়ে আগাম বন্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাওড়ে কোনদিন সমস্যা সৃষ্টি হয় না। সেখানে সর্বোচ্চ ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। ভোলায় উৎপাদন সব সময়ই ভাল হয়। এবার ব্লাস্ট রোগের কারণে উৎপাদন কিছুটা কম হলেও দেশে চালের কোন ঘাটতি নেই। ঘাটতি না থাকলে অস্বাভাবিকভাবে চালের দাম কেন বাড়বে? সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যেভাবে চালের দাম বেড়েছে তা খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। গুজবকে নিয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা করে দাম বেড়ে যাওয়া কেউ ভালভাবে নেবে না। ভারত চাল রফতানি করবে না এমন গুজব ছড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রতি অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, আপনাদের যোগসাজশ ছাড়া এ গুজবের মাধ্যমে এত দ্রুত দাম বাড়তে পারে না। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আপনারা সহযোগিতা করলে দ্রুত দাম কমে আসবে। জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল বারী বৈঠকে বলেন, আরও আগে চালের ট্যারিফ কমানো উচিত ছিল। তিনি বলেন, চটের বস্তায় চাল সরবরাহ করতে গিয়ে কেজিতে দেড় থেকে দুই টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এ্যাসোসিশেনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, চটের ব্যাগ তুলে দেন। এতে কেজিপ্রতি অন্তত দেড় টাকা করে কমে যাবে। এছাড়া যমুনা ব্রিজে নির্ধারিত টাকার চেয়ে তিনগুণ বেশি টোল আদায় করা হয়। কথায় কথায় ট্রাকের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়। ১৮ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া ২৫ হাজার করতে গেলে তার প্রভার চালের ওপরই পড়ে। এছাড়া রাস্তায় রয়েছে পুলিশের নানা হয়রানি। যেনতেন অভিযোগে রাস্তায় ৪-৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। মানিকগঞ্জে ট্রাকপ্রতি দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়। না দিলে মামলা তো আছেই, কখনও কখনও ট্রাকচালকদের মারধর করার ঘটনাও ঘটে। চালের ঘাটতি নিয়ে কোন কথা না বললেও ব্যবসায়ীরা চাল আমদানির কথা বলেছেন। তারা ট্রেনে করে ভারত থেকে চাল আমদানির কথাও বলেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে চাল আমদানি, উৎপাদন ও সরবারহে আগামী তিন মাস চটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যে যেভাবে আনতে পারেন চাল আনবেন, প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার দুই-তিন মাসের জন্য রিলাক্স করে দিয়েছি। যেভাবে চাল আনতে পারেন আনেন, কেউ বাধা দেবে না। এছাড়া ভারত থেকে ট্রেনে করে রোহনপুর দিয়ে চাল আনার জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তোফায়েল আহমেদ। দুই দফা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি চালের মজুদ কমে যাওয়ায় সরকার গত অর্থবছরের শেষদিকে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়। সেই সঙ্গে বেসরকারী পর্যায়ে আমদানি উৎসাহিত করতে ২৬ শতাংশ থেকে শুল্ক নামিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে। সরকারী-বেসরকারী পর্যায় মিলিয়ে গত আড়াই মাসে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি হলেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে, যার পেছনে মিল মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করে আসছে সরকার। সরকারী হিসাবেই মোটা চালের দাম গত এক মাসে বেড়েছে ১৮ শতাংশ, এক বছরে বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোন মোটা চাল নেই। ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধির মধ্যে মজুদদারি বন্ধে প্রশাসন গত সপ্তাহে বিভিন্ন রাইস মিলে অভিযান শুরু করে। কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল মলিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদের চালকলে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু রশিদকে জরিমানা করার পর এ কদিনে মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চার শ’ টাকার মতো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য চালের দাম। চালকলগুলোতে অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, এখন যেহেতু আপনাদের সঙ্গে বৈঠক হলো, তাই আমি সংশ্লিষ্টদের বলছি, এখন যাতে কোন ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার না হয়। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে চাল পরিবহনে বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও সরকার পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বাস দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তার এ বক্তব্যের পর সভাকক্ষে উপস্থিত বেশ কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, দু’-একদিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে। বৈঠকের পর বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ভাল একটি বৈঠক হয়েছে। দু’-একদিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে। উপজেলা পর্যায়ে আজ চালু হচ্ছে ওএমএস ॥ চালের দাম কমাতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী স্থগিত করে আজ বুধবার থেকে দেশের সব উপজেলা পর্যায়ে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) করবে সরকার। চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চালকল মালিক, আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভার পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আজ (বুধবার) থেকে উপজেলা পর্যায়ে ওএমএস চালু করব। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী আপাতত স্থগিত থাকবে। আশা করছি এর প্রভাব বাজারে পড়বে, চালের দাম কমতে শুরু করবে।
×