ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা থেকে জেদ্দা, মক্কা থেকে মদিনা- সর্বত্রই ছিল হাজীদের দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঢাকা থেকে জেদ্দা, মক্কা থেকে মদিনা- সর্বত্রই ছিল হাজীদের দুর্ভোগ

আজাদ সুলায়মান ॥ প্যাকেজের শর্ত ছিল হজে যাওয়া ও ঘরে ফেরা পর্যন্ত সব দায় এজেন্সির। এক নম্বর শর্ত ছিল হারাম শরিফের ৫শ’ গজের মধ্যে হোটেলে রাখা হবে। এ শর্ত লঙ্ঘন করে ঠেলে দেয়া হয়েছে আড়াই কিলোমিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায়। সৌদি সরকার ঘোষিত পরিত্যক্ত বাড়ির বেসমেন্টেও রাখা হয়েছে হাজীদের। যেখানে প্রচন্ড গরমে কবুতরের বিষ্ঠার মাঝে কাটাতে হয়েছে। আর খাবারের মান? পচা-বাসি। তিনবারের জায়গায় দুবেলা কোনক্রমে নিম্নমানের খাবার দিয়েই খালাস। এর চেয়েও জঘন্য পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে আরাফাতের ময়দানে। অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ নারী পুরুষদের মিনার মাঠ থেকে আরাফাতের ময়দান, সেখান থেকে মুজদালিফায় গাড়ি সার্ভিসের টাকা নেয়া হলেও ছিল না কোন গাড়ি। তাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি কোরবানির টাকা অগ্রিম নিয়ে সেটাও আত্মসাতের মতো অভিযোগ উঠেছে। অথচ এসব হাজীদের সেবা শুশ্রƒষা করার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে সাড়ে তিনশ’ জনবলের একটা বিশাল টিম পাঠানো হয়েছে। তাদের কাউকেই খুঁজে পাননি ভুক্তভোগী হাজীরা। এভাবেই ঢাকা থেকে জেদ্দা, মক্কা থেকে মদিনা সর্বত্র ছিল হাজীদের দুর্ভোগ। হজে যাওয়ার আগে যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা তো কান্নাকাটি করে ঘরে ফিরে গেছেন। কিন্তু যারা হজে যেতে সক্ষম হয়েছেন তারা ফিরছেন এখন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। শাহজালাল বিমানবন্দরে নামার পর তাদের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে অবিশ্বাস্য সব অভিযোগ। হজের নামে মানুষ এতটা জঘন্য ও প্রতারক হতে পারে এটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামসেদ। কক্সবাজার পৌর সভার কাউন্সিলর হিসেবে তিনি এলাকায় যথেষ্ট সুনাম ও প্রভাবের অধিকারী হলেও রহমানিয়া হজ কাফেলা নামের এক এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার মতো ১২২ জন এই কাফেলায় হজে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। তিনি এখন আছেন মক্কায়। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকেই দুর্ভোগ শুরু। জেদ্দায় যাওয়ার পর প্রায় দশ ঘণ্টা বিমানবন্দর থেকে নেয়া হয় মক্কার একটি হোটেলে। সেখানে ৩৯ আসনের হোটেলে তাদের ৬০ জনকে থাকতে দেয়া হয় গাদাগাদি করে। কিছু বলতে চাইলে এজেন্সি মালিক নাজিম উদ্দিন নিজে যুক্তি দেখান, ‘হজে এসেছেন, যত বেশি কষ্ট করবেন, তত বেশি সওয়াব পাবেন। কি আর করা? নীরবে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। জামসেদ নিজেও এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে চাননি। তারপর শুরু হয় খাবারের কষ্ট। তিন বেলার স্থলে দুবেলা, নিম্নমানের খাবার দিয়েই খালাস। তাও খেতে হয়েছে বার বার চেয়ে। মক্কার হোটেল থেকে মিনার মাঠে নেয়ার কথা ছিল গাড়িতে। সেটিও মেলেনি। তার আগেই উধাও এজেন্সি মালিক নাজিম উদ্দিন। বাধ্য হয়েই কিছুটা হেঁটে কিছুটা যৌথ ব্যবস্থাপনার গাড়িতে মিনার মাঠে পৌঁছান তারা। সেখান থেকে আরাফাতের ময়দানেও দেয়া হয়নি গাড়ি। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জনপ্রতি ৪০ রিয়াল দিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে আরাফাতে যান। সেখানেও দেখা মেলেনি ওই এজেন্সির কোন গাইড বা মালিকের। এখান থেকে রাত বারোটায় হেঁটে যেতে হয়েছে মুজদালিফায়। অথচ হজের রুকন অনুযায়ী সন্ধ্যায় মুজদালিফায় পৌঁছে এক সঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করতে হয়। প্রতারক এজেন্সির কারণে তাদের পক্ষে এ রুকন আদায় করা সম্ভব হয়নি। এমন দুর্ভোগের শিকার হয়ে আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামসেদ বাধ্য হন মক্কা হজ মিশনে অভিযোগ করতে। লিখিত অভিযোগ পেয়ে হজ মিশন থেকে তদন্ত করা হয়। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পদে পদে শর্ত লঙ্ঘন করেছেন রহমানিয়া হজ এজেন্সির মালিক যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জামসেদ বলেন, তার মতো ওই এজেন্সির ১২২ জন হাজীই নানাভাবে প্রতারণা ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। ওই দলে বয়স্ক নারী পুরুষকেও হাঁটতে বাধ্য করায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অথচ ২০১৬ সালেই ওই এজেন্সি রিপ্লেসমেন্টের আশ্বাসে এ সব হাজীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। ওই বছর পাঠাতে না পেরে এবার পাঠিয়েছে। তারপরও ঠিকমতো হজ করাতে পারেননি তিনি। এ অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তকারীরা প্রতারক নিজাম উদ্দিনকে প্রশ্ন করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। জামসেদ শনিবার রাতে মক্কা থেকে ফোনে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জানি না হজ কতটুকু করতে পেরেছি। পদে পদে মুনাফেকির শিকার হয়েছি। এজেন্সি মালিক বলেছে একটা, করেছে আরেকটা। যে কারণে আমরা এখনও মক্কায় পড়ে আছি। কবে নাগাদ মদিনায় যাব তা অনিশ্চিত। এখন এজেন্সি মালিক নিজামের কোন সন্ধানই মিলছে না। সে লাপাত্তা হয়ে গেছে। জামসেদের মতো এমন শত শত হাজী ঢাকা থেকে মক্কা মদিনায় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজীদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে বিচিত্র সব অভিযোগ। ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়ার পরই হাতের ডানে এপিবিএন পুলিশের ডেস্কের অভিযোগের খাতা রাখা হয়েছে। হাজীদের কার কি ধরনের অভিযোগ সবই লিখার জন্য পুলিশ পরামর্শ দিচ্ছে। জাহিদুল ইসলাম নামের হাজী লিখেছেন, মোতালেব হজ এজেন্সির মাধ্যমেই তিনি হজে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে গাড়ি বাড়ি ও খাবার দাবারের প্রচ- কষ্ট করতে হয়েছে তাকেসহ অন্যদের। পচা-বাসি খাবার দেয়ার প্রতিবাদ করার মোতালেব এজেন্সির আবু জাহের সোহেল নামের এক দালাল হাজীদের হুমকি দিয়েছে। বিষয়টি মক্কার হজ কাউন্সিলর মাকসুদর রহমানকে জানানো হয়েছে। পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের হাজী শাহেন শাহ আলী আকবরের অভিযোগÑ জেদ্দা থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে আসতে সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টা। আর বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর ফরিদাবাদের বাসায় ফিরতে সময় লেগেছে ৭ ঘণ্টা। হজফ্লাইটের অব্যাহত চাপে গোটা বিমানবন্দর এলাকার রাস্তা ভরে গেছে হাজীদের মালামালে। গাড়ি না পাওয়ায় অনেক হাজী রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাড়ি না পাওয়ায় বাড়ি ফিরতে পারছেন না হাজীরা। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তারাও যানজটের কারণে প্রধান সড়ক থেকে টার্মিনালের দিকে প্রবেশ করতে পারছেন না। নিয়মিত ফ্লাইটের কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি হজফ্লাইট এসেছে। ফলে একসঙ্গে হাজার হাজার যাত্রী টার্মিনাল থেকে বের হওয়ায় এই ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাধারণ যাত্রীরাও। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী হাজী শাহেন শাহ আলী আকবর সাংবাদিকদের বলেন- বেলা ১১টায় সৌদি এয়ারলাইন্সে ঢাকার বিমানবন্দরে আসি। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাগেজ ও জমজমের পানি হাতে পেয়েছি। কিন্তু গাড়ির জন্য পড়েছি বিপদে। চার ঘণ্টা পড়ে আছি বিমানবন্দরের রাস্তায়। শনিবার দুপুরে কজন হাজী একসুরে জানান, পবিত্র মক্কা-মদিনায় অসাধু হজ এজেন্সি ও স্থানীয় মোয়াল্লেমদের চরম অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণার শিকার হবেন তাদের কাছে এটা ছিল অবিশ্বাস্য। কেউ কেউ এয়ারপোর্টে নেমে কেঁদে ফেলছেন। তারা প্রতারক এজেন্সির বিচার দাবি করছেন। উন্নত মানের বাসা, স্বাস্থ্যসম্মত ভালো খাবার ও গাইড খরচের নামে এজেন্সিগুলো নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিলেও কাক্সিক্ষত সেবা পাননি হাজীরা। এমনকি চিকিৎসা ও পরিবহন সুবিধাসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা হাজীদের দেয়ার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি। তাদের যে ধরনের বাড়িতে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৌদি আরবে নেয়া হয়, বাস্তবে তা হয়নি। রাখা হয় অত্যন্ত নিম্নমানের ঘরে, গাদাগাদি করে। পবিত্র কাবা শরিফের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়ার কথা বলে তাদের রাখা হয় দূরবর্তী স্থানে। গাড়ির কথা বললেও সেখানে গাড়ি দেয়া হয়নি। গাইডের অভাবেও অপরিচিত জায়গায় হাজীদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে হজযাত্রীদের খাবার দেয়া হয়নি। এজেন্সিগুলো খাবার সরবরাহ বাবদ অর্থ নিলেও হাজীদের নির্ভর করতে হয়েছে বাইরে থেকে কিনে আনা খাবারের ওপর। আবার অনেকে দেশ থেকে নেয়া চিড়া মুড়ি খেয়েই দিন পার করেছেন। পরিত্যক্ত বাড়ির বেসমেন্টে হাজীদের দুঃসহ জীবন সৌদি সরকার ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে এমন একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে ৫৬ জন হাজীকে। কেআই ট্রাভেলসের এই হাজীদের জীবনে কি ভয়ঙ্কর সময় কেটেছে তা শুনলে শিহরে উঠতে হয়। মক্কার হেরেম শরিফ থেকে তিন কিলোমিটার দূরের ওই বাড়িতে যাদের থাকতে বাধ্য করা হয় তাদের একজন হাজী জোহরা খাতুন। কিছু জানতে চাইলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাদের যেখানে রাখা হয়েছিল সেটা ছিল খুবই নোংরা ভবন। দুর্গন্ধে বমির উদ্রেগ করত। তাদের কাফেলার সব হাজীদর ডায়ারিয়া হয়েছিল। এক সঙ্গে থাকা ৫৬ হাজীকে এমন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। তাদের কয়েকজনকে আবার রাখা হয় একটি ভবনের আন্ডার গ্রাউন্ডে। যেখানে কোন বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি মোবাইলের নেটওয়ার্কও ছিল না। ভবনের মধ্যে এমন গরম যে অনেকের শরীরে ফোসকা পড়ে গেছে। কে আই ট্রাভেলসের মোয়ালেম মশিউর রহমান রায়হান হাজীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। বার বার রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন হাজীরা। ট্রাভেলসের মালিক রফিকুল ইসলাম ছিল লাপাত্তা। এ সম্পর্কে জোহরা খাতুনের ছেলে সাংবাদিক কামরান করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িতে ৫৬ হাজীকে প্রায় দুঃসহ জীবনের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। হজের আগে কিছু খাবার দেয়া হলেও হজের পর কে আই ট্রাভেলসের মালিক ও মোয়াল্লেমের দেখা পাননি হাজীরা। মাসহ অন্য হাজীদের খাবার না দেয়ায় আমি ঢাকা থেকে ফোন করি মক্কায় অবস্থান করা হাব মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিমকে। তিনি তাৎক্ষণিক মক্কা থেকে খাবার নিয়ে ছুটে যান ওই ভবনে এবং স্বচক্ষে দেখেন হাজীদের সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র। তাসলিম সেখান থেকেই কে আই ট্রাভেলসের মালিকের ভাইকে সেখানে তলব করেন। জানতে চান কেন এ ধরনের অবহেলা করা হচ্ছে? কামরান জানান এ ঘটনায় তদন্ত করেও সব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এখন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে আশ্বস্ত করেন হাব মহাসচিব। হাজী আনোয়ারা বেগম জানান, তাদের কবুতরের পায়খানার ঘরে রাখা হয়েছিল। তার বয়স্ক স্বামী মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমাদের যখন মুজদালিফায় নেয়া হচ্ছিল তখন একটা বন্ধ গাড়ির ভেতরে রাখা হয়েছিল, বাতাস চলাচলের মতো অবস্থাও ছিল না। এরপর মুজদালিফা থেকে আমাদের ৯ ঘণ্টার পথ হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের প্রতিটা মানুষের চোখের পানি পড়ছে। সাভারের হাজী হাফিজুর রহমান খান নাঈম বলেন, দ্য সিটি ট্রাভেল এজেন্সি মহিলা-শিশুসহ তাদের ৪৫ জনকে কি যে কষ্ট দিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে এ-ক্যাটাগরি, তিন লাখ টাকায় বি-ক্যাটাগরি ও ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় সি-ক্যাটাগরির (থাকা-খাওয়া) সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও সব হাজীকে একই হোটেলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখে এই এজেন্সির মালিক নূর মোহাম্মদ, হাজী হাফিজুর রহমান খান নাঈম জানান, বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কা হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। একজন হাজী জানান, অত্যন্ত ছোট একটি কক্ষে ৪-৫ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাওয়ার পানি ছিল না, বাথরুম টিস্যু ছিল না। রুমের ভেতর দুর্গন্ধ। পলিথিনে দেয়া হয় খাবার। অনেক সময় পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাসার ওয়াশরুমে অজু করতে হলে সিরিয়াল ধরার কারণে মসজিদে জামাতে নামাজ ধরা যেত না। হাজী সেকেন্দার আলী সরদার জানান, হাজীদের ফ্রিজে রাখা অনেক পুরনো খাবার দেয়া হয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। এদিকে বেসরকারী ব্যবস্থাপনার মতোই সরকারী ব্যবস্থাপনায় যারা হজে গিয়েছেন তাদের দুর্ভোগও ভয়াবহ। এ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ১৯৮ জন সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান। দিনাজপুর সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোকাররম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, একটা রুমে ১২০ জনকে রাখা হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে। খাবার দিয়েছে ঝাল-নুন ছাড়া সেদ্ধ করা মাংস, পাতলা ডাল আর ভাত। আরাফা থেকে মুজদালিফা তিন ঘণ্টার পথ হাঁটিয়ে নিয়েছে আমাদের। গাড়ি দেয়নি। তিনি বলেন, সরকারী ব্যবস্থাপনায় কেউ হজে যাবেন না। এত অব্যাবস্থাপনা যে কল্পনাও করা যাবে না। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারত এবং পাকিস্তান থেকেও সরকারী ব্যবস্থাপনায় অনেকেই হজে যান। আমরা দেখেছি তাদের প্রতি কত যতœ নেয়া হয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের হাজীরা সৌদি আরবে যেমন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তার ছিটেফোঁটাও পাননি বাংলাদেশীরা। সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ থেকে ফিরে আসা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনিস ফিরোজাও একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মুয়াসসাসা ডিজির দুঃখ প্রকাশ হাজীদের এসব এন্তার অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে হাব সভাপতি শাহাদাত হোসেন তসলিমকে। তিনি নিজে বেশকিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ক্ষুব্ধ চিত্তে এজেন্সি মালিকদের যেমন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তেমনি সৌদি আরবের মুয়াসসাসা কর্তৃপক্ষকেও আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করেছেন। বিশেষ করে মিনা আরাফাত ও মুজদালিফার ময়দানে হাজীদের প্রয়োজনীয় তাঁবু, খাবার ও গাড়ি সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালনকারী সৌদি মুয়াসসাসার ডিজির কাছে কৈফিয়ত চান। ভুক্তভোগী হাজীরা জানান, মক্কার কাকিয়ার লাইলিন নূর কমিউনিটি সেন্টারে হাব এক নৈশভোজের আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুয়াসসাসা দক্ষিণ এশিয়া জোনের ডিজি ওমর সিরাজ আকবর ও বাংলাদেশের ধর্মসচিব আবদুল জলিলসহ অন্য কর্মকর্তারা। সেখানে শাহাদত হোসেন তসলিম দীর্ঘ পৌনে এক ঘণ্টা ইংরেজী বক্তৃতায় ওমর সিরাজ আকবরের উদ্দেশ্যে মিনা আরাফাত ও মুজাদালিফায় হাজীদের খাবার তাঁবু ও গাড়ি সরবরাহ না করার বেশকিছু অভিযোগ প্রমাণাদিসহ তুলে ধরেন। এ সময় চরম ওমর সিরাজ আকবর তার বক্তৃতায় এ ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে আশ্বাস প্রদান করেন। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাব মহাসচিব শাহাদত হোসেন তসলিম জনকণ্ঠকে বলেন, হাজীদের সেবার জন্য নির্ধারিত মোয়াল্লেম ফি দুধরনের। একটা ঢাকা থেকে মক্কার হোটেলে থাকা খাওয়ার-এজেন্সির নিজস্ব গাইড বা মোয়াল্লেমরা পালন করতে হয়। অপরটি হচ্ছে মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় হজের তিনদিন তাঁবুতে থাকা খাওয়া গাড়িতে যাতায়াতসহ প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিয়ে থাকে সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত মুয়াসসাসা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এবার হাজার হাজার হজযাত্রীকে মিনার মাঠের তাঁবুতে রাখা হয়েছে গাদাগাদি করে, মিনা থেকে আরাফাতে যাওয়ার গাড়িও দেয়া হয়নি অনেককে, সেখান থেকে মুজদালিফায় নেয়ার সময়ে দেয়া হয়নি যানবাহন। খাবার নিয়েও কষ্ট দেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক এজেন্সি আবার নিজের টাকায় গাড়ি ভাড়া করে এই দায়িত্ব পালন করেছে। আরাফাতের ময়দানে ফজরের পর পরই পৌঁছার পরিবর্তে দুপুরের পর অনেককে সেখানে যেতে হয়েছে শুধু মুয়াসসাসার অবহেলার দরুণ। এমন অভিযোগ ছিল ভূরি ভূরি। হাবের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব হয়েছে খোঁজখবর নিয়ে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। কি করছে এত বিশাল টিম? হাজীদের সেবা শুশ্রƒষার জন্য প্রতি বছর ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকশ’ সদস্যের দল পাঠায়। এবারও সাড়ে তিনশ’ জনবল পাঠানো হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ পিয়ন চাপরাশিসহ সব ক্যাটাগরির কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠানো হয়। এ নিয়ে এবারও ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। তখন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, হাজীদের সেবার জন্যই তাদের পাঠানো হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা কি পঞ্চগড়ের একজন অতি সাধারণ কৃষক হাজীকে কি ধরনের সেবা শুশ্রƒষা করবে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। কউ কেউ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কায় বাংলাদেশের হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি। বাংলাদেশ থেকে যেসব কর্মকর্তা হাজীদের সেবার কথা বলে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তাদেরও খোঁজ পাননি কোন হাজী। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে যাদের হজ টিমে পাঠানো হয় তারা সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। হজ করা, কেনাকাটা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো ছাড়া তাদের কাউকেই খুঁজে পায়নি কোন হাজী বা এজেন্সি। এমনকি সার্বক্ষণিক হজের পরিসংখ্যানগত তথ্য সরবরাহের জন্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা আনোয়ারকে ফোন করেও কেউ পায়নি। তাকে কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- আর কি পালন করছেন জানতে চাইলে ধর্মসচিব আবদুল জলিল জনকণ্ঠকে বলেন, সবাই দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দায়িত্ব পালন করেছে। আনোয়ার জেদ্দা বিমানবন্দরে সারারাত জেগে ডিউটি করেছে। কি বলছেন হজ কর্তৃপক্ষ এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল (জেদ্দার হজ কাউন্সিলর) মাকসুদুর রহমান বলেন, অনেক অভিযোগ পেয়েছি, একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব তদন্ত করছেন। আমরা নিজেরাও খতিয়ে দেখছি। এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সম্পর্কে ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারন বলেন, আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সৌদি আরবে কিছু এজেন্সি হাজীদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। দায়ী সকল এজেন্সির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। অতীতে কে কি করেছে সেটা দিয়ে বিচার হবে না। আমরা এবার সংসদীয় কমিটি হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সার্বিক বিষয় মনিটর করছি। এবার সংসদীয় কমিটির দুজন সদস্যকেও পাঠানো হয়েছে হজে। তাদের একজন নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারির সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলেছি। অভিযোগের সব নোট নিয়েছি। কোথায় কি ধরনের ভুলত্রুটি কার কি দোষগুণ আছে, কে কি ধরনের ন্যায় অন্যায় বা প্রতারণার মতো জঘন্য অপরাধ করেছেÑ সবই তদন্তের আওতায় আনা হবে। ছাড় দেয়া হবে না কাউকেই। কেননা হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান। এসব বরদাশত করার মতো নয়। এজেন্সির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে-সবই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একটু অপেক্ষা করুণ। দেখবেন কমপক্ষে ৫০টি এজেন্সির বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল, ফৌজদারি মামলা জেল জরিমানার মতো শাস্তির আওতায় আনা হবে। যাতে জীবনে হজ ব্যবসার সাদ মিটে যায়। প্রতি বছর মুষ্টিমেয় কয়েকটা এজেন্সির জন্য সরকারের এত বিশাল অর্জন নসাৎ হয়ে যাবে তা কেউ-ই ছাড় দিবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীরও কঠোর নির্দেশনার রয়েছে।
×