ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শরৎচন্দ্র, হুমায়ূন আহমেদ এবং অন্যান্য

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শরৎচন্দ্র, হুমায়ূন আহমেদ এবং অন্যান্য

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ স্মারক গ্রন্থ। জনপ্রিয়তার দিক থেকে যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের তুলনা করা হয় তার মৃত্যুর পর এমন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল কিনা জানা নেই। না হওয়ারই কথা, কেননা বিপণন ব্যবস্থার এমন করিৎকর্মা প্রকরণ সেকালে সম্ভবত শরৎচন্দ্রের আয়ত্তের বাইরেই ছিল। তবে প্রবোধ চন্দ্র সান্যালের আয়োজনে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা একটি শরৎ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল সে তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি এও রয়েছে যে, প্রবোধ চন্দ্র সান্যালরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের লেখার কঠোর সমালোচক ছিলেন। ‘চরিত্রহীন’ নিন্দার ঝড় তুলেছিল। উপন্যাসটিকে বলা হতো ইম্্মর‌্যাল, লেখককে লম্পট। তার উপাধিই হয়ে গিয়েছিল ‘চরিত্রহীন’। ‘শেষ প্রশ্ন’ও কম আক্রান্ত হয়নি। ‘শেষ শ্রাদ্ধ’ নামে ব্যঙ্গ কৌতুক কার্টুন ছেপেছে শনিবারের চিঠি। সে তুলনায় হুমায়ূন আহমেদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ। এত তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে পড়তে হয়নি। সমালোচকের চেয়ে তার ভক্ত ও পরিতোষকের সংখ্যা বেশি ছিল বলেই হয়ত। তার ‘প্রোডাক্ট’-এর মনোপলি এত শক্তিশালী ছিল যে, তার লেখার সমালোচনা করার অসুবিধাও ছিল। প্রথমত সমালোচকের উল্টো আক্রমণের শিকার হওয়াÑ হুমায়ূনের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত, নিজের অক্ষমতা থেকে বিষোদ্গারণ ইত্যাদি জাতীয় মন্তব্যে। ঈর্ষা থেকে সমালোচনা যে হয়নি তা নয়। হয়েছে। তবে সাহিত্য বিচারের দিক থেকে যারা সত্যিকারের সমালোচনা করতে পারতেন তাদের অনেকেই হুমায়ূন বলয়ে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন যে, তাদের পক্ষেও কাজ করা সম্ভব হয়নি। তারপরও সমালোচনা তো হয়েছেই এবং স্বাভাবিকভাবে তা তাকে স্পর্শও করেছে। ‘আমি’ বইয়ে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ লেখাতে শরৎচন্দ্রকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজেকেই যেন উপস্থাপিত করেন হুমায়ূন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ফিরে যাই। তাকে সম্মান দেখানোর আতিশয্যে এক প্রবন্ধকার লিখেছেন, সস্তা ধারার জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রকে পেছনে ফেলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে গেছেন কত দূর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মানেই পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি। ... বেচারা শরৎচন্দ্রের সমস্যা, তার রচনা সব বাঙালী মেয়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে পড়ে। আমাদের ধারণা বহুলোক যা পছন্দ করে তা মধ্যম মাত্রার হবে। কারণ বেশিরভাগ মানুষের মেধা মধ্যম মাত্রার। বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিকদের প্রচুর ইন্টারভিউ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি প্রশ্ন বেশিরভাগ সময়ই থাকে- আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক কে? প্রশ্নের উত্তরে কেউ কখনও শরৎচন্দ্রের নাম দেন না। হয়ত ভয় করেন এই নাম দিলে নিজে মিডিওকার খাতায় নাম উঠাবেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কঠিন গলায় শরৎচন্দ্রের নাম বলতে দ্বিধাবোধ করেননি, কারণ তিনি ভালমতোই জানতেন তিনি যাই বলেন না কেন তাকে ‘মিডওকার’ ভাবার কোন কারণ নেই।’ শরৎচন্দ্রের লেখা ‘বাঙালী মেয়েরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে’ পড়েছে। হুমায়ূনের লেখা হয়ত একালের তরুণরা হাসতে হাসতে কিংবা কৌতুক করে পড়ছে। তবে চোখের জল আর হাস্যকৌতুকের বিনিময় মূল্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। শরৎচন্দ্রেরটা জানা না গেলেও হুমায়ূনেরটা জানা যায় স্মারক গ্রন্থে মাজহারুল ইসলামের লেখা থেকে ‘সেটা ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ‘অন্যদিন’- এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অন্যপ্রকাশ’। ‘সৃজনশীল প্রকাশনার উৎকর্ষের সন্ধানে’ সেøাগানে যাত্রা শুরু ১৯৯৭ সালের একুশের বইমেলায়। শুরু থেকেই নানাভাবে আমরা চেষ্টা করছিলাম কী করে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশ করা যায়। সাবের ভাইয়ের সহযোগিতায় আমাদের আগ্রহের কথা জানানো হলো হুমায়ূন আহমেদকে। বই প্রকাশের জন্য তিনি অগ্রিম রয়্যালিটি হিসেবে দশ লাখ টাকা প্রদানের কথা বললেন। আসলে তার বই দেয়ার ইচ্ছে ছিল না বলেই এরকম কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ওই পরিমাণ অর্থ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরুনো এই তরুণেরা দিতে পারবে না, তাই এদের বইও দিতে হবে না। পরে তিনি এ কথাটা বহুবার বলেছিলেন।’ এই ‘বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী’র খবর সেকালের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়ত তেমনভাবে পাননি। কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত পেরিয়ে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ হয়ে তিনি তখন গ্রামবাংলার শান্ত সমাজের ব্যবচ্ছেদ করছেন। প্যারীচাঁদ, দীনবন্ধুরা সামন্ত সমাজের ক্ষয়ের দিকটা তুলে এনেছেন। একটি নতুন সমাজ বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দেয়া ও তার বিকাশের ধারার সঙ্গে এরপর এলো প্রথম সফল উপন্যাস বঙ্কিম চন্দ্রের হাত ধরে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য একজন সমাজসচেতন মানুষ, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোকিত বঙ্কিম চন্দ্র উপন্যাসে থেকে যান মূলত সামন্ত। ‘সাম্য’ বা ‘বঙ্গদর্শন’-এর ক্ষমতাধর লেখক আধুনিক বুর্জোয়া মানুষটি উপন্যাসে একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে তিনি কথক বা কাহিনীকার। সমাজের বাস্তব বিকশিত রূপ বা গতিশীল ধারাটিকে তিনি সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। তার চরিত্ররা তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবিকশিত। তারা উপন্যাসের শুরুতে যা শেষ পর্যন্ত প্রায় তাই থাকে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করছি, ‘সমাজের ছবি বেশ ছড়ানো রয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে। বাংলার গ্রামে বর্ণহিন্দু সমাজের অনেক খুঁটিনাটি তার লেখায় বেশ উজ্জ্বল রেখায় উঠে এসেছে। তাদের ছোটলোকামি, তাদের কোন্দল, তাদের রেষারেষি শরৎচন্দ্রের আগে বাংলা উপন্যাসে অনুপস্থিত। কিন্তু এ সমাজ অনড় ও অচল, এর মধ্যে কলহ আছে কিন্তু গতি নেই, এই সমাজ কোলাহলময়, কিন্তু স্পন্দনহীন। শরৎচন্দ্রের প্রেক্ষিত তাই প্রামবাংলার স্থিরচিত্র। শরৎচন্দ্র আর্কষণীয় ভঙ্গিতে একটির পর একটি চরিত্র সৃষ্টি করেন, সমাজের স্থিরচিত্রে সেইসব চরিত্র সমাজের ভেতরকার স্র্রোতধারাকে নিয়ে আসতে পারে না। এ কথা খুবই সত্যি যে, তার গল্পে নির্যাতিত চাষীর সশ্রম পদার্পণ ঘটেছে, কিন্তু তার বিপুল শিল্প সৃষ্টিতে কী শিল্পমানে, কী পরিমাণে তাদের উপস্থিতি গুরুত্বহীন। যেসব সংস্কার এই সমাজে বিশ্বাসের অনুচিত মর্যদা বলে গৃহীত সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা ধরতে পারেন না তিনি। বরং তাদের প্রতি তার অনুমোদন রয়েছে। মনু যেসব বিধান দিয়ে গেছেন, বল্লাল সেন যেসব বালাই বাধিয়ে দিয়ে গেছেন তারই মর্যাাদা আরও প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন শরৎচন্দ্র। কিন্তু মনু তো চিরস্থায়ী নন, বল্লাল সেনের রাজত্বের অবসান ঘটেছে অনেক আগে। সমাজ কি ওই আমলেই থাকবে? না আছে? সেইসব বিধান ও সেইসব বালাইকে গৌরব দিতে গিয়ে শরৎচন্দ্র তার চরিত্রকে খাটো করে ফেলেন। বস্তুনিষ্ঠ থাকা আর সম্ভব হয় না। তাই সমাজবাস্তবতা যাকে বলি তা তার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল।’ তিনি সম্ভবত ইচ্ছে করেই নিজেকে এর বাইরে রেখেছিলেন। হয়ত জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে বলেছেন, ‘সমাজ সংস্কারের কোন দুরভিসন্ধি আমার নাই। তাই বইয়ের মধ্যে আমার মানুষের দুঃখ বেদনার বিবরণ আছে, সমস্যাও হয়ত আছে, কিন্তু সমাধান নেই। ও কাজ অপরের, আমি শুধু গল্প লেখক, তাছাড়া আর কিছুই নই।’ হুমায়ূন আহমেদ অনেকটা এরকমই। তার চরিত্ররা জীবনযাপনের মধ্যেই সীমিত। তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে না। তিনিও বলেছেন, ‘আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলো এসেছে কি আসেনি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোন সমস্যা হয়েছে। হয়তবা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে কোন লেখায় হাত দিলে মনে হয় চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কিনা। ‘মধ্যাহ্নে’ও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তারপর ও ...’। বোঝা যাচ্ছে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক তিনি। ভুলেও যেন পাঠক ঘোর লাগা থেকে ছুটে না যায় সে জন্য উদগ্রীব হয়ে বলে রাখেন ‘চমকে উঠবেন না।’ সময়কে ধরার চেষ্টা থেকে ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে তিনি ফিরে যান উনিশ শ’ পাঁচে। উনিশ শ’ পাঁচ থেকে সাতচল্লিশ উপন্যাসের পটভূমি হলে চরিত্রের বাস্তবানুগামিতা নেই। বঙ্কিম চন্দ্রের আলোড়ন তোলা উপন্যাস দুর্গেশ নন্দিনীর পটভূমি তার সময় থেকে তিন শ’ বছর আগের। সে তুলনায় এমন কিছুই না। সমসাময়িক সমাজ বা এর বিকাশ ইত্যাদি নিয়ে তিনি মোটেই ভাবিত নন। হুমায়ূন আহমেদ একজন অসাধারণ কাহিনীকার ছিলেন। তার বর্ণনার চৌম্বক আকর্ষণ পাঠককে তরতরিয়ে টেনে নিতে পারে। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার অভিনব চমৎকারিত্ব দিতে পারেন তিনি, আবার পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরেজ করারও। প্রশ্নের মুখোমুখি তো দূরের কথা কিছু পড়লাম কি? এ সংশয় জাগে। মৃত্যুর এত বছর পরও শরৎচন্দ্র যেভাবে বেঁচে আছেন হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে কি সম্ভব অতোটা দীর্ঘায়ু হওয়া? কি জাদু ছিল তার হাতে? রহস্য জানতে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় হাজির হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের দ্বারে। কথাসাহিত্যিক শংকর জানাচ্ছেন ‘কয়েকদিন ঘুরিয়ে শরৎচন্দ্র অবশেষে তরুণ লেখককে মন্ত্রগুপ্তি দিয়েছিলেন লিখে যদি টিকে থাকতে চাও এবং টু পাইস করতে চাও, তা হলে কখনও মা লক্ষ্মীদের চটিয়ো না। রসিক শরদিন্দু বহু বছর পরে আমাকে একবার চুপিচুপি বলেছিলেন, এই উপমহাদেশে সাকসেসফুল লেখক হওয়ার টিপটা টপ সিক্রেট! মেয়েরা যা পছন্দ করে এদেশের পুরুষরাও শেষ পর্যন্ত তাই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে থাকে, আর সেটা বুঝেছিলেন বলেই শরৎচন্দ্র অপরাজেয়।’ হয়ত তাই।
×