ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ে চাল নিয়ে মিল মালিকদের চলছে চালবাজি

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঠাকুরগাঁওয়ে চাল নিয়ে মিল মালিকদের চলছে চালবাজি

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও ॥ সদর উপজেলা সালন্দর সিংপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন। পেশায় রিকশাচালক। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে টাকা উপার্জন করেন রাতে সেই টাকা দিয়ে চাল ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ দুইদিনে চালের দাম কেজি প্রতি ১০-১৫ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। আবুল হোসেন জানান, প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়। সেই টাকা থেকে রিকশার মালিককে ২০০ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে সংসারের চাল, ডাল, সবজি কিনে বাড়ি যেতে হয়। কিন্তু চাল দাম বৃদ্ধি যেভাবে হয়েছে বাড়িতে চুলা জ্বালানো আমাদের মতো নিন্মবিত্ত পরিবারের কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আবুল হোসেনের পরিবার নয়, ঠাকুরগাঁওসহ সারাদেশে চালের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো হতাশ হয়ে পড়েছেন। এবার সরকারিভাবে ঠাকুরগাঁওয়ে চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। লোকসানের অজুহাতে চুক্তিবদ্ধ হয়নি জেলার বেশির ভাগ মিলার। ঠাকুরগাঁও জেলায় এবার ৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু মিলার (চাল সরবরাহকারী) সংকটের কারণে চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। ঠাকুরগাঁও জেলায় ১৮০০ মিলের মধ্যে মাত্র ৮০০ জন মিলার ১৮ হাজার মেট্রিক টন চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু লোকসানের অজুহাতে ৮০০ জনের মধ্যে অর্ধেক মিলার চুক্তি সম্পন্ন করেনি বলে খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়। সেই সুযোগে মিলার ও ফরিয়া ঠাকুরগাঁওয়ে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান সংগ্রহ করে পরে চাল তৈরি করে গুদামে মজুদ করে রাখে। সরকার বলছে রাইস মিলগুলোতে পর্যাপ্ত চাল মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তরের শস্যভান্ডারখ্যাত ধানের জেলা ঠাকুরগাঁও চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছে একটি সিন্ডিকেট এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে থেকে আমদানি ও মজুত সত্বেও এ জেলায় বন্যার পানির মতো চালের দাম বেড়েই চলছে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর ও মধ্যম আয়ের মানুষগুলো। অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়ায় মিল মালিকদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধান সংকটের কারণে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকার এবার ধানের দাম বৃদ্ধি করে সরকারি গুদামে ৩৪ টাকা কেজি দরে চুক্তিবদ্ধ করায় অনেকে লোকসানে পড়েছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলায় অধিকাংশ মিলগুলোতে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এরপরও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। এখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বাড়িয়েছে মিল মালিকরা। শিবগঞ্জ বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা জানায়, মিলগুলোতে চাল পাওয়া গেলেও ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছেন তারা। এক সপ্তাহ আগে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল মিল মালিকরা বিক্রি করেছিল ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এখন তা বিক্রি করছে ২ হাজার ৭৫০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজি বস্তার বিআর-২৮ চাল ২ হাজার ৩৫০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৬০০ টাকা, বিআর-২৯ চাল ২ হাজার ৩০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৫৫০ টাকা, স্বর্ণা ২ হাজার ১০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৩৫০ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ১ হাজার ৮০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছে মিল মালিকরা। শহরের কালিবাড়ি বাজারের চাল ব্যবসায়ী হাসেম আলী বলেন, মিলে চাল নেই, এমন কথা বলছেন না কোনো মিল মালিক। তবে সব মিল মালিকই একসঙ্গে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তাদের বাধ্য হয়েই বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও এই মুহূর্তে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যেসব ধান ব্যবসায়ী এবার বোরো মৌসুমে ধান কিনে মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করেছেন তারা জানান, বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত ধান কিনে মজুদ করেছে মিল মালিকরা। সদর উপজেলার ধান ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম জানায়, তাদের কাছে বোরো মৌসুমে এবার ৭৫ কেজির প্রতিবস্তা মিনিকেট ধান ১ হাজার ৭০০ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ধান ১ হাজার ৫০০ টাকা দরে কিনেছে মিল মালিকরা। এই হিসাবে মিলের উৎপাদন খরচসহ প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৩৬ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৩৩ টাকা এবং প্রতিকেজি হাইব্রিড মোটা চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ব্যবসায়ীদের বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৫৫ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৫৫ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। মিল মালিকরা তাদের বাজার থেকে ধান কেনা ও উৎপাদন খরচ ধরে বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি চাল গড়ে প্রায় ২৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি করায় বাজারে অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে চালের দাম। খুচরা ব্যবসায়ী সাদেকুল ইসলাম জানান, তারা মিলগুলোতে চাল কিনতে গিয়ে ব্যাপক মজুদ লক্ষ্য করেছেন। তারা জানান, মিলগুলোতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করলে চালের বাজার অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারে। দেশে সাম্প্রতিক বন্যা, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং ভারত চাল রফতানি করবে না এমন গুজবে অধিক মুনাফার আশায় ইচ্ছামতো চালের দাম বৃদ্ধি করেছে মিল মালিকরা মনে করছেন। আর এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান রাজু জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাওয়ার কারণে বেড়েছে চালের দাম। এক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোনো কারসাজি নেই। মিলে মজুদ থাকা সত্বেও হঠাৎ মিল মালিকরা প্রতি বস্তা চালের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বৃদ্ধি করল কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। মিলে যে পরিমাণ ধান থাকার কথা সেই পরিমাণে ধান নেই। তাই চাল উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। জেলায় বেশির ভাগ মিলারদের কাছে মজুদ চাল নেই বলেও তিনি জানান। ঠাকুরগাঁও জেলা খাদ্য কর্মকর্তা আশ্রাফুজামান জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করা হয়েছে। সরকারি লক্ষ্যমাত্রা যেহেতু মিলাররা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেহেতু মিল মালিকরা চাল মজুদ করে রাখতে পারেন বেশি দামে বিক্রির জন্য। ঠাকুরগাঁও ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম জানান, চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে মিল মালিকরা অন্য কোথাও ধান বা চাল মজুদ করে রেখেছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।
×